নিজস্ব প্রতিবেদক:
সরকারি প্রতিষ্ঠান নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির মালিকানাধীন ‘বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি (বিসিপিসিএল) লিমিটেড’এর কয়লাভিত্তিক পায়রা-১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটি গত বছরের শেষদিকে উৎপাদনে আসে। প্রায় ২শ কোটি ডলারের এ প্রকল্প থেকে ইতোমধ্যে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ যোগ হচ্ছে ৬৬০ মেগাওয়াট। তবে আপাতত বিদ্যুতের চাহিদা না থাকায় কেন্দ্রটির ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরেকটি ইউনিট বন্ধ রয়েছে।
এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে কিছুটা দূরে একই উপজেলায় এবার বাংলাদেশ-চীনের যৌথ মালিকানায় আরেকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে নিয়ে আসতে দ্রুত কাজ করছে সরকার। এবারের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করছে সরকারের আরেকটি কোম্পানি রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল)। চীনের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি নরিনকো ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে যৌথ মালিকানায় পটুয়াখালীর ধানখালী ইউনিয়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে আরপিসিএল।
বিশ্বে নরিনকোর অনেক ধরনের ব্যবসা থাকলেও অস্ত্র ব্যবসায়ী হিসেবে কোম্পানিটির পরিচিতি বিশ্বব্যাপী। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, আগামী ২০২৩ সালের মধ্যে নির্মাণাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসবে। একই বছরের আগস্টের মধ্যে দ্বিতীয় ইউনিট থেকেও বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারবে।
সরেজমিনে প্রকল্পটি পরিদর্শনে দেখা যায়, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে চীন এবং স্থানীয় লোকবল বিরামহীন কাজ করছে। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, করোনা মহামারীর কারণে গত বছর প্রায় সব প্রকল্পে স্থবিরতা নেমে আসে। পটুয়াখালী ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা প্রকল্পটিও ব্যতিক্রম নয়। তবে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টায় পূর্বনির্ধারিত ব্যয় ও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই প্রকল্পটির কাজ শেষ হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রে নির্মাণাধীন এলাকা পরিদর্শনকালে প্রকল্প পরিচালক মো. তৌফিক ইসলাম জানান, ইতোমধ্যে প্রকল্পের কাজ ২৭ শতাংশ শেষ হয়েছে।
২০২৩ সালের মধ্যে উৎপাদনে নিয়ে আসতে কাজ করা হচ্ছে। করোনা ভাইরাসের কারণে প্রকল্পের কর্মকা-ে কিছুটা স্থবিরতা দেখা দিলেও এখন কাজ চলছে পুরোদমে। কয়লার পরিবহন এবং বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশে কয়লা পরিবহনে জেটি নির্মাণ করা হয়েছে। পায়ারা বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে ব্যবস্থায় কয়লা আসছে, পটুয়াখালী কেন্দ্রেও একই ব্যবস্থায় কয়লা আসবে। গ্রিডলাইনের বিষয়ে তিনি বলেন, গ্রিডলাইন নির্মাণের দায়িত্ব বাংলাদেশ পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) । আশা করছি, সেটা তারা করবে।
তবে প্রকল্পের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, কয়লা পরিবহন এবং গ্রিডলাইনে বিদ্যুৎ সরবরাহে একটু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিশেষ করে সময়মতো গ্রিডলাইন নির্মাণ হবে কিনা, তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। কারণ পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্রিডলাইনও সময়মতো নির্মাণ করা যায়নি।
নতুন এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে আরপিসিএল এবং নরিনকো ইন্টারন্যাশনালের মধ্যে ২০১৬ সালের ৯ মে সমঝোতা স্মারক সই হয়। আরপিসিএল সূত্র জানায়, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তাদের ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ছাড়াও অন্যান্য ধরনের জ্বালানিসহ ২৭৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতার নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেয় সরকার। এর অংশ হিসেবে পরিচ্ছন্ন কয়লা প্রযুক্তিসম্পন্ন পরিবেশবান্ধব (আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহারের মাধ্যমে) ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা তাপভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচেছ।
কেন্দ্রটির জন্য এরই মধ্যে ধানখালী ইউনিয়নে ৯১৫.৭৪ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণের ফলে বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের জন্য ৩০ একর জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন আবাসিক এলাকা। এতে ২৮১টি বাড়ি, মসজিদ, স্কুল, ক্লিনিক, দোকান, কমিউনিটি সেন্টার, সাইক্লোন শেল্টার, খেলার মাঠ, কবরস্থান, পুকুর ইত্যাদি নির্মাণ করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে দ্রুত এগুলো বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
নির্মিত বাড়িগুলো কারা পাবে- এমন প্রশ্নে আরপিসিএলের নির্বাহী পরিচালক সেলিম ভূইয়া আমাদের সময়কে বলেন, মূলত ডিসি অফিস থেকে এই তালিকা আরএনপিএলকে দেওয়া হয়েছে। যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তাদের এই বাড়ি দেওয়া হবে। জমি অধিগ্রহণের জন্য নিয়ম অনুযায়ী তিনগুণ দাম দেওয়া হয়েছে। আর এই বাড়ি আরপিসিএল দায়বদ্ধতা থেকে তৈরি করে দিয়েছে।
জানা গেছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে ১ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিচ্ছে চায়না এক্সিম ব্যাংক। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বয়লার, স্টিম টারবাইন এবং জেনারেটর আগামী আগস্টে চলে আসবে জানায় কর্তৃপক্ষ।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ¦ালানি কয়লা কোন দেশ থেকে আনা হবে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, এই কেন্দ্রে প্রতিদিন প্রায় ১২ হাজার মেট্রিক টন কয়লা লাগবে। যা আনা হবে ইন্দোনেশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে। মাদার ভেসেল গভীর সমুদ্রে রেখে পরে ছোট ছোট লাইটার জাহাজে কয়লা আনা হবে জেটিতে। এ ছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেশিনের স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী ব্লেডিং করে কয়লা ব্যবহার করা হবে। পরিবেশের ক্ষতি হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিদ্যু কেন্দ্রটি যেহেতু সর্বাধুনিক প্রযুক্তির আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজির; ফলে এতে পরিবেশের ক্ষতির আশঙ্কা নেই। প্রকল্পে ২২০ মিটার উঁচু চিমনি থাকবে।
এ ছাড়াও থাকবে অ্যাশপন্ড, যেখানে ৯৯ ভাগ ফ্লাইঅ্যাশ বয়লার টিউবের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ হবে। আবার ফ্লাইঅ্যাশের স্থানীয় বাজারে চাহিদা থাকায় বিক্রিরও ব্যবস্থা থাকবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হলে তা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আরপিসিএল সূত্রে জানা যায়, বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি অনুয়ায়ী এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ ২৫ বছর ধরা হয়েছে। তবে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে এখান থেকে ৪০-৫০ বছর পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।
প্রকল্পের নির্বাহী পরিচালক নরিনকো কোম্পানির কর্মকর্তা চি ইউয়ে বলেন, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাংলাদেশের বড় কেন্দ্রের মধ্যে অন্যতম। এখানে বিশ্বমানের আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হবে। কয়লা ব্যবহারের কারণে পরিবেশের ক্ষতি রোধে সব ধরনের আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন অনুসরণ করব আমরা।