শনিবার , নভেম্বর ১৬ ২০২৪
নীড় পাতা / জাতীয় / ‘আমার দেখা নয়াচীন’ নিছক ভ্রমণকাহিনী নয়; আরও কিছু…

‘আমার দেখা নয়াচীন’ নিছক ভ্রমণকাহিনী নয়; আরও কিছু…

জয়দেব নন্দীঃ

১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে নয়া চীনের পিকিং-এ এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তদানীন্তন পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলা থেকে শান্তি সম্মেলনে যোগদান করেন। পূর্ববাংলা থেকে তাঁর ভ্রমণ-সঙ্গী ছিলেন পূর্ববাংলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সহ-সভাপতি জনাব আতাউর রহমান খান, ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস ও ইউসুফ হাসান। নয়া চীন ভ্রমণ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু মিয়ানমার, ব্যাংকক ও হংকংও গিয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালে রাজবন্দী থাকাবস্থায় বঙ্গবন্ধু সেই ভ্রমণের সরস বিশ্লেষণ করেছেন ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে।

৩২ বছর বয়সের টগবগে তরুণ নেতার নয়া চীন ভ্রমণ; অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি, তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি, বাস্তবতা-সবকিছু-ই দারুণ দক্ষতা ও পরম মমতায় লিপিবদ্ধ করেন। বয়স তখন তাঁর ৩৪ বছর।

১৯৫২ সালের অক্টোবর মাস, বঙ্গবন্ধুর প্রথম চীন ভ্রমণ। নয়াচীনের অবিসংবাদিত নেতা মাও সেতুং এর প্রতি সেদেশের মানুষের অকৃত্রিম ভালবাসা, নয়াচীনের রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক অবস্থা ও বাস্তবতা বঙ্গবন্ধু এ ভ্রমণে প্রত্যক্ষ করেন। চীন ভ্রমণের এসব অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেন; যেখানে তিনি তৎকালীন পাকিস্তান ও চীনের রাজনৈতিক-আর্থসামাজিক অবস্থার তুলনা, কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের চর্চা প্রভৃতি বিষয়াদি প্রাঞ্জলভাবে আলোচনা করেন। এটিই বঙ্গবন্ধুর ‘আমার দেখা নয়াচীন’।

উল্লেখ্য, ১৯৫৭ সালে শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ-এইড দফতরের মন্ত্রী থাকাকালে পাকিস্তান সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে তিনি দ্বিতীয় বার চীন ভ্রমণ করেন।

চীন দেশ ভ্রমণের ইচ্ছা বঙ্গবন্ধুর আগে থেকেই ছিল। গ্রন্থের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু লেখেন:

“জেলে থাকতে ভাবতাম, আর মাঝে মাঝে মাওলানা ভাসানী সাহেবও বলতেন, যদি সুযোগ পাও একবার চীন দেশে যেও”।

আমার দেখা নয়া চীন গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু চীন ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথাই শুধু বলতে চাননি; বরং এই ভ্রমণের আদ্যোপান্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে মনের ভিতর লালন-পালন করেছিলেন। একটা বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন তাঁর ভিতরও নিহিত ছিল। সদ্য স্বাধীন সাধের পাকিস্তান জন্ম লগ্ন থেকেই তা পূরণে ব্যর্থ হয়। পাকিস্তান নামক সদ্য স্বাধীন দেশে ৫৬ ভাগের বেশি মানুষ পূর্ব পাকিস্তানে নিগৃহীত হচ্ছে, বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, নিপীড়ণের শিকার হচ্ছে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে নয়া চীনের ঘুরে দাঁড়ানো বঙ্গবন্ধুকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার দালাল চিয়াং কাইশেকের নির্যাতন-নিপীড়নকে পরাভূত করে চীনের জাতীয়তাবাদী নেতা মাও সেতুং এর হাত ধরে নয়া চীনে যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, ধনী-গরীবের ভিতর যে সমতা এসেছে, একটা শোষণমুক্ত সমাজ গঠিত হয়েছে; তা বঙ্গবন্ধুকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছিল। একটা শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের প্রেরণা হয়তো বঙ্গবন্ধু এখান থেকে পেয়েছিলেন, যার ইঙ্গিত এই গ্রন্থে রয়েছে। মাঝে মাঝে নয়াচীনের নয়া শাসকদের রাষ্ট্রপরিচালনার বিভিন্ন ইতিবাচক দিকের সাথে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর শোষণের তুলনা করে পাকিস্থানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার মানুষের উপর যে বিমাতাসুলভ আচরণ করেই চলেছে, তা তুলে ধরেছেন।

নয়া চীনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু গ্রন্থের ৬৬ পৃষ্ঠায় লেখেন:
“আমি লেখক নই, অনুভব করতে পারি মাত্র, লেখার ভিতর দিয়া প্রকাশ করার মতো ক্ষমতা খোদা আমাকে দেন নাই।”

বঙ্গবন্ধু নিজেকে লেখক দাবি না করলেও তাঁর রচিত ‘আমার দেখা নয়া চীন’ গ্রন্থটির প্রাঞ্জল বর্ণনা, জটিল বিষয়বস্তুকে সরলভাবে উপস্থাপন পাঠক-হৃদয়ে ছুঁয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা গ্রন্থের ভূমিকাতে লিখেছেন:

“এই ভ্রমণ কাহিনী অতি প্রাঞ্জল বর্ণনা দিয়ে তিনি পাঠকের জন্য উপভোগ্য করেছেন। প্রতিটি শব্দ, বাক্য রচনার যে পারদর্শিতা আমরা দেখি, তাতে মুগ্ধ হয়ে যাই।”

একজন তরুণ রাজনীতিকের উপলব্ধিতে এসেছে দারুণ সব অভিজ্ঞতার বয়ান এবং নয়া চীন রাষ্ট্রের সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের গল্প। বিপ্লবের পর সমাজে যে পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়, বঙ্গবন্ধু নয়া চীন ভ্রমণের মধ্য দিয়ে তা আত্মস্থ করেছিলেন এবং তার বাস্তব প্রয়োগের স্বপ্নও হয়তো তিনি অন্তরে বপন করেছিলেন, তার ইঙ্গিতও এ গ্রন্থে রয়েছে।

‘আমার দেখা নয়াচীন’-এ নয়া চীনকে চেনানোর পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু নিজেকেও চিনিয়েছেন ভিন্নভাবে। ভ্রমণ-কাহিনী পড়তে পড়তে পাঠকের যেন কোনরূপ বিরক্তি না আসে, সেজন্যে বঙ্গবন্ধু রসবোধের পরিচয় দিয়ে প্রধান অনুষঙ্গগুলোকে উপজীব্য করে তুলতে সঙ্গতিপূর্ণ ভ্রমণের মজার ঘটনাগুলোকে তুলে ধরেছেন। যেমন- গ্রন্থের ২৮ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লেখেন:

“আতাউর রহমান সাহেব, মানিক ভাই, ইলিয়াস ও আমি রাস্তায় বেড়াতে বেরিয়েছি। হঠাৎ ১৬/১৭ বৎসরের একটা মেয়ে আতাউর রহমান সাহেবের কোটে একটা গোলাপ ফুল লাগাইয়া দিতে অগ্রসর হয়। মেয়েটি কলারে হাতও দিয়াছে, খান সাহেব হঠাৎ যেন চমকাইয়া উঠলেন। পরে ধাক্কা দিয়া ফুল ছুঁড়ে ফেলে রাগে ঘোঁতঘোঁত করতে করতে এগিয়ে চললেন। মেয়েটি আশ্চর্য হয়ে দূরে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আমাদের মতো যুবকদের দিকে নজর না পড়ে আপনার ওপর পড়ার কারণ কী? আতাউর রহমান সাহেব তো রাগে অস্থির, আর মানিক ভাই তো তাঁর ‘রাজনৈতিক মঞ্চের’ মতো ঘুরাইয়া ফিরাইয়া উনার পিছনে লাগলেন। আমরা খুব হাসাহাসি শুরু করলাম। বেচারা ভদ্রলোক রাগে শোকে দুঃখে কথা বলেই যেতে লাগলেন। উল্লেখ্য, হংকংয়ে ফুল দেওয়াটা হলো ‘প্রেম নিবেদন’।”

আবার গ্রন্থের ৩৮ পৃষ্ঠার ঘটনাটিও প্রণিধানযোগ্য:
“মানিক ভাইয়ের কথা কিছু না বললে অন্যায় হবে। মানিক ভাই যে এত খেতে পারেন, সে ধারণা আগে আমার কোনোদিন ছিল না। হয়তো কোনোদিন একটা মুরগীই খেয়ে ফেলে, সাথে সাথে ডিম, মাছ, ফলফলাদি, বসে বসে শুধু খায় আর খায়। মানিক ভাই বলেন, “বেশি কথার কাম নাই। খাবার সময় গোলমাল করো না। চুপচাপ খাও, সময় পাওয়া গেছে। দেশে লীগ (মুসলিম লীগ) আমলে কী খেতে পাই মনে নাই।” রুমে ফিরে এসে আমি, আতাউর রহমান সাহেব ও মানিক ভাই খুব হাসাহাসি করতাম, মানিক ভাইয়ের খাওয়া নিয়ে। আমি আর আতাউর রহমান সাহেব মানিক ভাইয়ের পিছনে লেগেই থাকতাম।”

মহান নেতা মাও সেতুং এর নেতৃত্বে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল চিয়াং কাইশেকের পতন হয়। বিপ্লব পরবর্তী সময় নয়াচীনের মনোজগতে আসে এক বিরাট পরিবর্তন। ধনী-গরীব, মহাজন-কৃষক, মালিক-শ্রমিকের মধ্যে ব্যবধান কমে আসে। কৃষিজমি, কলকারখানা; মালিক-শ্রমিক, মহাজন-কৃষকের হয়ে ওঠে। নয়া চীন মাত্র তিন বছরে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে থাকে। গ্রন্থের ৫১ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর বয়ানে-

“আমার একটা অভ্যাস আছে। নিজের দাড়ি নিজেই শেভ করি। কোনোদিন সেলুন বা কোথাও শেভ করি না। আমার যে ব্লেড ছিল তাহা হঠাৎ ফুরিয়ে গেল। আমি বাজারে গেলাম ব্লেড কিনতে। সমস্ত দোকান খুঁজলাম, ব্লেড পেলাম না। এক দোকানে তিন চার বৎসরের একটা পুরানো ব্লেড বের করলো তার উপরে জং পড়ে গেছে। দাড়ি তো দূরের কথা ‘চাড়িও’ (নখ) কাটবে না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ভাই সমস্ত পিকিং শহরে একটা ব্লেড পেলাম না, কারণ কী? দোকানদার ভাঙা ভাঙা ইংরেজি জানে। আমাকে বললো, বিদেশ থেকে এই সমস্ত জিনিস আমরা আনি না। আমাদের নিজেদের ঘরে যে ক্ষুর তৈরি হয় তা দিয়েই শেভ করি। যে পর্যন্ত আমরা ব্লেড ফ্যাক্টরি করে নিজেরা তৈয়ার করতে না পারবো, সে পর্যন্ত ব্লেড কেউই ব্যবহার করবো না। আমরা বিদেশকে কেন টাকা দিবো?”

বিপ্লবের মধ্য দিয়ে চীনের নবযাত্রা শুরু হয়েছিল কম্যুনিস্টদের হাত ধরে। এই কম্যুনিস্টদের চীনের মানুষ ভালবাসতো না, ভয় পেত। কিন্তু অত্যাচারী চিয়াং কাইশেক এর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে চীনবাসী। তখন আইন বলে চীনে কিছু ছিল না। আইন ছিল চিয়াং কাইশেকের অনুসারী জমিদারদের হাতে। নারী-পুরুষ-শিশু কেউই এসব জমিদারদের হাত থেকে রেহাই পেত না। শ্রমিক-কৃষকরা মহাজন-মালিকদের দ্বারা নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়। কৃষক জমির খাজনা না দিতে পারলে কৃষকের মেয়ে, বউকে তুলে নিয়ে কামনা চরিতার্থ করতো। চিয়াং কাইশেকের অনুসারীদের বিরুদ্ধে কেউ টুঁ শব্দটি করতে পারতো না। চিয়াং কাইশেকের নিষ্ঠুর নির্যাতন, অত্যাচারের বিরুদ্ধে ‘বেআইনী’ কম্যুনিস্টরাই চীনের জনগণকে রুখে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করলো। মানুষ কম্যুনিস্টদের অপছন্দ করলেও বাঁচার তাগিদে কম্যুনিস্টদের আহবানে সাড়া দিল।

নয়াচীন সরকার কায়েম হবার পর তারা ‘লাঙল যার, জমি তার’ প্রথা প্রবর্তন করলো। বড় বড় জমিদারের জমি বাজেয়াপ্ত করে কৃষকের মধ্যে বণ্টন করা হল। অনাবাদি খাস জমিও কৃষকের মাঝে চাষের জন্য বণ্টন করে দেয়া হল। যখন কৃষক বুঝতে পারলো, এ জমিতে চাষ করলে কেউ আর ফাঁকি দিতে পারবে না, তখন তারা পুরো উদ্যমে চাষাবাদ শুরু করলো। শুরু হলো নয়াচীনের নবতর যাত্রা। এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু গ্রন্থের পৃষ্ঠা: ৮৯-৯০ তে লেখেন-

“নয়া চিনে একখণ্ড জমি দেখলাম না, যা অনাবাদি অবস্থায় পড়ে আছে। রেললাইনের পাশে যে গর্তগুলি পড়ে থাকে সেগুলিতেও ফসল করা হয়েছে। যদি কোন জমি ইচ্ছাকৃতভাবে পড়ে থাকে তাহলে সরকার কঠোর শাস্তি দেয়।…

কৃষক যে জিনিস উৎপাদন করে তার দাম আমাদের দেশের মতো কম হতে পারে না। আমাদের দেশে যখন ধান পাট চাষির ঘরে থাকে তখন দাম অল্প হয়। যখন মহাজনদের ঘরে থাকে তখন দাম বাড়তে থাকে। চাষি উৎপাদন খরচও পায়না। আর অন্যান্য জিনিস যা কৃষকের কিনতে হয়, যেমন নুন, তেল, কাপড়, এগুলির দাম এত বেশি থাকে আমাদের দেশে, যে কৃষক যা উৎপাদন করে তা দিয়ে তাদের সংসার চলে না।

কিন্তু নয়াচীনে একটা সামঞ্জস্য বিধান করেছে, কৃষক যা বিক্রি করে তার দাম দিয়ে ভালোভাবে অল্প দামে তেল, নুন, কাপড় কিনতে পারে। এতে তাদের জমির ফসলের দাম দিয়েই সংসার চালানো সহজ হয়েছে। গরিবদের পাঁচ টাকায় এক মণ পাট বিক্রি করে ৪ টাকায় এক সের ডাল তেল কিনতে হয় না তাদের দেশে।

প্রত্যেক এলাকাতে সরকারি দোকান আছে সেখানে সস্তায় সমস্ত জিনিস পাওয়া যায়। কোন দোকানদার ইচ্ছা করলেই বেশি দাম নিতে পারে না। কারণ যদি লোকে জানতে পায় যে কোন দোকানদার বেশি দাম নিচ্ছে তখন তারা সরকারি কর্মচারীদের খবর দিয়ে নিজেরাই ধরাইয়া দেয় এবং মিটিং করে ঠিক করে ঐ দোকানদারের দোকানে কেউই জিনিসপত্র কিনতে পারবে না। এতে চাষিদের যথেষ্ট উপকার হয়েছে। দেশের ভিতর গণজাগরণ এসেছে বলে এটা সম্ভবপর হয়েছে।”

শুধু আইন করে নয়; জনমত গঠন, মানবীয় ব্যবহার, প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় কঠোর আচরণ, কর্মসংস্থান-বাসস্থান সৃষ্টির মধ্যদিয়ে নয়াচীন ভিক্ষাবৃত্তি, বেকার সমস্যা, ডাকাতি, আফিম নেশামুক্তি, বেশ্যাবৃত্তিকে নির্মূল করতে সক্ষম হয়েছিল। সেজন্য বঙ্গবন্ধু গ্রন্থের ৯৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন:

“আইন করে কোনো অন্যায় কাজই বন্ধ করা যায় না, অন্যায় বন্ধ করতে হলে চাই সুষ্ঠু সামাজিক কর্মপন্থা, অর্থনৈতিক সংস্কার ও নৈতিক পরিবর্তন।”

মাত্র ৩ বছরের মধ্যে চীন সরকার ও তাদের জনগণ এক হয়ে কাজ করে দেশটিকে বদলে ফেলেছে; যা বঙ্গবন্ধুকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। বিশেষ করে চীনের জনগণের রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য, দেশের প্রতি ভালোবাসা দেশপ্রেম- বঙ্গবন্ধুকে মুগ্ধ করেছে। এ বিষয়গুলি বঙ্গবন্ধু গ্রন্থের বিভিন্ন পৃষ্ঠায় তুলে ধরেছেন। গ্রন্থের ৯১ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন:

“সরকার ডাক দিলো- একশত মাইল একটা রাস্তা করতে হবে। তোমাদের যথেষ্ট অসুবিধা হতেছে; সরকারের অত টাকা নাই, তাই তোমাদের নিজেদের কাজ নিজেদেরই করাই উচিত। প্রত্যেকের আসতে হবে, অন্তত দু’দিন কাজ করে দিতে হবে। সমস্ত লোক এসে কাজ শুরু করল, সরকার তাদের খাবার দিল। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এক মাসের ভেতর সমস্ত রাস্তা করে দিল। এইভাবে নয়াচীনে হাজার হাজার গঠনমূলক কাজ জনসাধারণ করেছে, কারণ জনসাধারণের আস্থা আছে সরকারের ওপরে এবং মনে করে একাজ তাদের নিজেদের।”

চীনের জনগণের চরিত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু গ্রন্থের ৬৪ পৃষ্ঠায় লেখেন:

“এদেশের লোকের মনে অহংকার নাই। সকলকেই আপন করতে চায়। সকলেই মনে করে ‘রাষ্ট্র আমাদের’-একে গড়ে তুলতে হবে। ”

মাত্র তিন বছরের মধ্যে চীনের শিক্ষা ব্যবস্থায় আসে আমূল পরিবর্তন। সেটি পর্যবেক্ষণের জন্য বঙ্গবন্ধুর আগ্রহ ছিল। এজন্য বঙ্গবন্ধু চীন ভ্রমণে গিয়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে ঘুরে দেখেছেন। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে লিখেছেন:

“আমাদের দেশের মতো কেরানী পয়দা করার শিক্ষাব্যবস্থা আর নাই। কৃষি শিক্ষা, শিল্প, ইঞ্জিনিয়ারিং, টেকনিক্যাল শিক্ষা দেয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। সেখানে আমার সাথে আলাপ হল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মি. হালিমের। তাঁর একটা চীনা নামও আছে, সেটা আমার মনে নেই। তিনি আমাকে বললেন, বাধ্যতামূলক ফ্রি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছি। প্রত্যেক ছেলে মেয়েকে স্কুলে দিতে হয়। সরকার তাদের যাবতীয় খরচ বহন করে। কৃষকদের জন্য কৃষি স্কুল করা হয়েছে। আমাকে একটা স্কুল দেখানো হয়েছিল, সেখানে যুবকদের কিছুদিনের জন্য শিক্ষা দিয়ে খামার জমিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। শ্রমিকদের জন্য স্কুল করা হয়েছে। প্রত্যেক শিল্প কেন্দ্রের কাছে স্কুল আছে। বড়দের শিক্ষা দেয়া হয় কাজের ফাঁকে, আর তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য আলাদা বন্দোবস্ত আছে। সকল দিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেল যে, মাত্র ৪ বৎসরে তারা শতকরা ৩০ জন লোককে লেখাপড়া শিখিয়ে ফেলেছে। গর্ব করে আমাকে আবার বললো, দশ বছর পরে যদি চীনে আসেন তবে দেখবেন একটা অশিক্ষিত লোকও নাই।”

এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু পৃষ্ঠা: ৬০-এ একটা তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে নয়াচীনের ইতিবাচক ভবিষ্যতের কথা ব্যক্ত করেন:

“এক এক দেশে এক এক প্রকারের ‘স্বার্থ সংশ্লিষ্ট শ্রেণি’ (প্রিভিলেজড ক্লাস) আছে- যেমন আমাদের দেশে অর্থশালী জমিদাররা ‘প্রিভিলেজড ক্লাস’, অন্যদেশে শিল্পপতিরা ‘প্রিভিলেজড ক্লাস’; কিন্তু নতুন চীনে দেখলাম শিশুরাই ‘প্রিভিলেজড ক্লাস’। এই ‘প্রিভিলেজড ক্লাস’টা সরকারের নানা সুযোগসুবিধা পেয়ে থাকে। নয়াচীন সরকারের হুকুম, প্রত্যেক ছেলেমেয়েকে স্কুলে দিতে হবে, একটা পরিমাণ ঠিক করে দিয়েছে, সেই পরিমাণ খেতে দিতে হবে। পোশাক ঠিক করা আছে, সেইভাবে পোশাক দিতে হবে। যাদের দেবার ক্ষমতা নাই, তাদের সরকারকে জানাতে হবে। সরকার তাদের সাহায্য করবে। এভাবেই নতুন মানুষের একটা জাত গড়ে তুলছে নয়াচীন। ১৫-২০ বৎসর পরে এরা যখন লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়ে দেশের জন্য কাজ করবে, তখন ভেবে দেখুন নয়াচীন কোথায় যেয়ে দাঁড়াবে?”

চীনের শান্তি সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিবৃন্দ শান্তির সপক্ষে বক্তব্য প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু নিজেও বক্তব্য রাখেন। সফরসঙ্গী হিসেবে পাকিস্তান এবং পূর্ব বাংলা থেকে যে সকল প্রতিনিধিবৃন্দ শান্তি সম্মেলনে গিয়েছিলেন, তাদের মধ্যেও কয়েকজন বক্তব্য প্রদান করেন। বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা তাদের নিজ ভাষায় বক্তব্য প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু নিজেও মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করেন। পশ্চিম বঙ্গ থেকে আসা লেখক মনোজ বসুও বাংলায় বক্তৃতা করেন। কিন্তু অনেকে মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে ইংরেজি ভাষায় বক্তব্য দিয়েছেন, যা বঙ্গবন্ধুর ভাল লাগে নাই। উল্লেখ্য করা প্রয়োজন, বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় বক্তব্য প্রদান করেছিলেন। তারও ২২ বছর আগে তরুণ শেখ মুজিব চীনের শান্তি সম্মেলনে বাংলায় বক্তব্য প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু গ্রন্থের ৪৩ পৃষ্ঠায় লেখেন:

” বাংলা আমার মাতৃভাষা। মাতৃভাষায় বক্তৃতা করাই উচিত। কারণ পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের কথা দুনিয়ার সকল দেশের লোকই কিছু কিছু জানে। মানিক ভাই, আতাউর রহমান খান ও ইলিয়াস বক্তৃতাটা ঠিক করে দিয়েছিল। দুনিয়ার সকল দেশের লোকই যার যার মাতৃভাষায় বক্তৃতা করে। শুধু আমরাই ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা করে নিজেদের গর্বিত মনে করি।”

নয়াচীন ভ্রমণকালে বঙ্গবন্ধু প্রত্যক্ষ করেছেন, নয়াচীনে নারী-পুরুষ প্রকৃত অর্থেই সমানাধিকার ভোগ করছে। নারী-পুরুষ সমানভাবে দেশের জন্য কাজ করছে, আয়-রোজগার করছে; কেউ কারও উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে না। সমাজ থেকে নারী-পুরুষ সমান সম্মান পাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু গ্রন্থের পৃষ্ঠায় খেদ করেই বলেছেন:

“আমাদের দেশের কথা চিন্তা করে দেখুন। যদিও আইনে আমাদের দেশে নারী পুরুষের সমান অধিকার, তথাপি আমাদের দেশের শিক্ষিত অশিক্ষিত লোকের মনে এই ধারণা যে, পুরুষের পায়ের নিচে মেয়েদের বেহেশত। পুরুষ যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। মেয়েদের নীরবে সব অন্যায় সহ্য করতে হবে বেহেশতের আশায়। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, মেয়েদের নির্ভর করতে হয় পুরুষদের অর্থের ওপর। কারণ আমাদের দেশে অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত কিছু সংখ্যক মোল্লা পর্দা পর্দা করে জান পেরেশান করে দেয়। কোনো পরপুরুষ যেন মুখ না দেখে। দেখলে আর বেহেশতে যাওয়া হবে না।… ইসলামিক ইতিহাস পড়লে জানা যায় যে, মুসলমান মেয়েরা পুরুষদের সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে যেত, অস্ত্র এগিয়ে দিতো। আহতদের সেবা শুশ্রূষা করতো। হজরত রসুলে করিমের (সা.) স্ত্রী হজরত আয়েশা সিদ্দিকা নিজে বক্তৃতা করতেন, ‘দুনিয়ায় ইসলামই নারীর অধিকার দিয়াছে’।”

তরুণ বয়সেই বঙ্গবন্ধু সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অসাম্প্রদায়িক মানবিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতায় রূপান্তরিত হচ্ছিলেন; এ গ্রন্থ তাঁর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। গ্রন্থের ৬৩ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন:

“যাক বাবা, আমেরিকার বিরুদ্ধে সত্যকথা লিখে বিপদে পড়তে চাই না, কারণ আজ আমেরিকা পাকিস্তানের ‘একমাত্র বন্ধু’। এক মুসলিমলীগের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বলেই প্রত্যেক বৎসর জেল খাটি। আবার এদের বিরুদ্ধে বলে কি ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলবো?”

১৯৫২ সালে চীন ভ্রমণকালে বঙ্গবন্ধু গভীর দৃষ্টি দিয়ে নয়াচীন পর্যবেক্ষণ করেন। চীন সম্পর্কে কিছু ভবিষ্যৎ বাণী তিনি এ গ্রন্থে দিয়েছিলেন। বিশ্বে বর্তমান চীন রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক অবস্থান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর সেই ভবিষৎবাণী আজ বাস্তবে রূপ পেয়েছে।

আরও দেখুন

চাঁপাইনবাবগঞ্জে ‘রক্তের খোঁজে আমরা’র ২য় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত

নিজস্ব প্রতিবেদক চাঁপাইনবাবগঞ্জ ………..চাঁপাইনবাবগঞ্জে রক্তদান সামাজিক সেবামূলক সংগঠন ‘রক্তের খোঁজে আমরা’র ২য় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হয়েছে। শুক্রবার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *