রবিবার , নভেম্বর ১৭ ২০২৪
নীড় পাতা / উন্নয়ন বার্তা / “আমরা তার তরে একটি সাজানো বাগান চাই”

“আমরা তার তরে একটি সাজানো বাগান চাই”


সুরজিত সরকার:
একটু পিছনে ফিরে দেখা যাক। গতবছরের জুলাই মাসে করোনার ওপর খাড়ার ঘা বন্যা। এরমধ্যে বন্যায় বাড়ি ডুবে যায় গর্ভবতী সুরাইয়ার। সে সময় পাশে দাঁড়িয়ে মহানুভবতা দেখিয়েছিলেন বিনছের আলী। আর সেই মহান কাজে সামিল হয়েছিলেন নলডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার আব্দুল্লাহ আল মামুন। তখন নারদ বার্তায় “বিনছের আলীর মহানুভবতা ও ইউএনও’র সহযোগিতা” শিরোনামে সংবাদ প্রকাশও হয়।

নতুন করে আবারও অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন হলো নলডাঙ্গায়। এবারও দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী সেই ইউএনও মামুন। তবে পার্শ্ব চরিত্র এবং ঘটনার স্থান আলাদা তবে মূল ঘটনার মিল রয়েছে সুরাইয়ার সঙ্গে। ঘটনার শুরু গত বৃহস্পতিবার, ঘড়ির কাটায় তখন রাত ৯টা নলডাঙ্গা মাধনগর স্টেশন প্লার্টফর্মের আলো আঁধারিতে সন্তান ভূমিষ্টের যন্ত্রণায় ছটফট করছেন এক নারী। নাম সোনিয়া খাতুন(২০)। অথচ অসহ্য যন্ত্রনায় চিৎকার দিয়ে উঠলেও তার কাছে এগিয়ে যায়নি স্টেশন প্লাটফর্মে অবস্থানরত নারী পুরুষদের কেউ। অনেকে দেখেছেন দর্শক হিসেবে হয়ত মজার খোরাক হিসেবে নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ কাছে গেলেও সোনিয়ার যন্ত্রনা আর সুস্থ্যতা নিয়ে ভাবেনি। মানসিক প্রতিবন্ধী বা পাগল ভেবে সোনিয়ার পাশে থাকতে চাননি অনেকেই।

এদিকে রাত ঘরিয়ে ঘড়ির কাঁটা দশটা প্রসব যন্ত্রণার মাত্রা বেড়ে গেছে, বাতাস ভারী হয়ে ওঠা সে চিৎকারে প্রথম এগিয়ে আসেন উপজেলার মাধনগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান ও স্থানীয় কিছু লোকজন। সোনিয়ার অবস্থা দেখে তাকে উদ্ধার প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে নলডাঙ্গা বাজারের একটি বেসরকারী ক্লিনিকে নিয়ে ভর্তি করান। সেখানেই রাত সাড়ে এগারোটায় ভূমিষ্ট হয় সোনিয়ার সন্তান।

নলডাঙ্গার মাটিতে মহানুভবতার নতুন নজির সৃষ্টি হয়। প্রথম মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়া সোনিয়ার কোল জুড়ে আসে ফুটফুটে একটি ছেলে সন্তান। মানুষ মানুষের জন্য জীবন জীবনের জন্য প্রবাদ গুলো বেঁচে থাকে এজন্যই হয়ত। এবারে সোনিয়ার পরিচয় কিংবা তার অনাগত সন্তানের পরিচয় জানতে চাইলে জানা যায়, এক বছর যাবত তার স্বামীর সন্ধানে বহু স্থান ঘুরে বেড়িয়েছেন কিন্তু কোথাও তার সন্ধান মিলেনি। বাসস্ট্যান্ড, রেলওয়ে স্টেশনসহ পথে ঘাটে স্বামীর সন্ধানে গর্ভবতী অবস্থায় ছুটে বেড়িয়েছেন।

সোনিয়া খাতুন জানান, তার জন্মস্থান চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার উজিরপুর গ্রামে। বাবার নাম মঞ্জু, দুই ভাই রিমন ও শিমুল এবং তার এক সৎ মা রয়েছে। সেখানেই তারা বসবাস করেন।

পরিচয়হীন ছেলেকে বিয়ে করার কারণে পরিবারের লোকজন তাকে দেখতে পারে না। তাই সেখানে যেতেও পারেনি সোনিয়া। বাবার দারিদ্রতা আর ছোট বেলায় মা মারা যাওয়ায় পড়ালেখা বা ঠিকমত খাবার কোনটিই জুটত না সোনিয়ার কপালে। শেষমেশ বেছে নেন ভিক্ষাবৃত্তির পথ। বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন জায়গাতে ট্রেনের মধ্যে ঘোরা ফেরা আর ভিক্ষা করেই চলছিল তার জীবন-জীবিকা।

এরইমধ্যে ট্রেনের ভিতর কোন একদিন অচেনা এক ছেলের সাথে তার পরিচয় হয়। প্রায় তিন বছর আগে সান্তাহার রেলওয়ে স্টেশনে তাদের বিয়ে হয় ওই ছেলেটির সাথে এবং সেখানেই তাদের সংসার চলে। কিন্তু কোথায় তার স্বামীর বাড়ি, কি তার পরিচয় সে বিষয়ে কিছুই জানা হয়নি সোনিয়ার। সরলতার সুযোগ নিয়ে স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায় যখন জানতে পারে সোনিয়া অন্তঃস্বত্তা। পরে আর তার সাথে দেখাও হয়নি খোঁজ মেলেনি।

কোথায় পাবে তার স্বামীকে? তার তো কোন ঠিকানাই জানা নেই তার। গর্ভবতী অবস্থায় এক বছর ধরে নাটোরের আব্দুলপুর রেলস্টেশনে বসবাস আর বিভিন্ন জনের কাছে সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে থাকে। এদিকে সন্তান ভূমিষ্টের সময় এগিয়ে আসে। স্থানীয় একজনের পরামর্শে স্বামীকে খুঁজতে বৃহস্পতিবার (০১ এপ্রিল) বিকেলে আলী হায়দার নামে এক ভ্যান চালককে সাথে নিয়ে উত্তরা এক্সপ্রেস ট্রেনযোগে সান্তাহারের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সোনিয়া। ট্রেনের ভিতরে যখন অসুস্থ্য হয়ে পড়ে তখন মাধনগর রেল স্টেশনে নেমে পড়েন।

ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক আতাউর রহমান জানান, মানবিক কারণে ওই মেয়েকে প্রসব বেদনা অবস্থায় নলডাঙ্গার একটি বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি করি এবং বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করি। খবর পেয়ে ইউএনও আব্দুল্লাহ আল মামুন স্যার মেয়েটির সবসময় খোঁজ খবর নিয়েছেন। মেয়েটি যাতে তার ভুমিষ্ঠ শিশুটিকে নিয়ে অভিভাবকদের কাছে ভালো ভাবে পৌঁছাতে পারে, সে বিষয়ে সবরকম পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং অর্থ সহায়তাও করেছেন। যখন জানতে পারেন সোনিয়ার এখন আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। ইউএনও মামুন যোগাযোগ করেন জেলা ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে সেখানেও দেখা দেয় একটি সমস্যা। জেলার বাহিরে যেতে হলে নিয়ম মাফিক অনুমতি নিতে হবে ঢাকা থেকে।

অ্যাম্বুলেন্স জেলার বাহিরে নেওয়ার জন্য ফায়ার সার্ভিস আন্তরিকতার সঙ্গে রাতারাতি অনুমতি পেয়ে যায়। এদিকে যোগাযোগ করা হয় নলডাঙ্গা থেকে গতবছর বদলি হয়ে যাওয়া বর্তমান কর্মস্থল চাঁপাইনবাবগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাকিব আল রাব্বির সঙ্গে। যেন সোনিয়া তার নবাগত বাচ্চাটিকে নিয়ে তার পরিবারের কাছে ফিরতে পারে। অবশেষে উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় সোমবার (৫ এপ্রিল) দুপুরে লকডাউনের মধ্যে বিশেষ নিরাপত্তায় ফায়ার সার্ভিস অ্যাম্বুলেন্সে সোনিয়া খাতুন ও তার শিশু সন্তান নিরাপদে ফিরে যান বাবার বাড়ি।

নলডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, বিষয়টি অত্যন্ত মানবিক। মেয়েটি যাতে তার শিশু সন্তানকে নিয়ে অভিভাবকের কাছে ভালোভাবে ফিরে যেতে পারে এবং যাতে ভাল পরিবেশে থাকতে পারে, সে ব্যাপারে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করা হয়েছে। স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, ক্লিনিক ও ফায়ার সার্ভিসকে মানবিক কাজে সহায়তার হাত বাড়ানোর জন্য ধন্যবাদ জানান তিনি।

পৃথিবীতে খারাপের পাশাপাশি ভালো রয়েছে, মাঝে মাঝে সেই ভালোগুলো অনুপ্রেরণা হয়ে আসে আমাদের মাঝে। অনেক খারাপ দেখতে দেখতে বিষিয়ে উঠা মনে বসন্তের বাতাসের মত দোলা দেয়। ধন্যবাদ সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ ইউএনও মামুনকে ভালোর সঙ্গে থাকার জন্য। তবে তারপরও কিছু কথা থেকে যায়, অনাগত শিশুটি এই সমাজে বাঁচার অধিকার পাক এবং মানুষের মত মানুষ হোক ।

আরও দেখুন

তারেক রহমানের ইতিবাচক রাজনীতি আশার সঞ্চার করছে:দুলু

নিজস্ব প্রতিবেদক,,,,,,,বিএনপি কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেছেন,গতানুগতিক রাজনীতির বাইরে তারেক …