আবুল মোমেন
সাংবাদিকতা ঠিক পেশা নয়, একটি ব্রত। ব্রতধারী মানুষ আর দশজনের মতো হয় না। তাই প্রকৃত সাংবাদিক এক স্বতন্ত্র প্রজাতির মানুষ।
সব ব্রতী মানুষই একটু ভিন্ন ধাঁচের হয়ে থাকেন, গড়পড়তা সংসারী মানুষের মতো নয়। অনেকেই একটু খ্যাপাটে প্রকৃতিরও হয়ে থাকেন। এদের তৃতীয় নয়ন, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় থাকে। উড়ো খবর শুনলে বন্য প্রাণীর মতো কান খাড়া হয়ে যায়, খবরটা চাঞ্চল্যকর হলে ঝাঁপিয়ে পড়ার ইচ্ছা প্রবল হয়ে ওঠে। ক্ষুধা-তৃষ্ণার মতো আদিম প্রবৃত্তি তাকে অস্থির করে তোলে।
হ্যাঁ, সাংবাদিক সাহসী মানুষ, কুচ-পরোয়া-নেই মনোভাব নিয়েই চলেন। তার বাইরের দাপুটে চেহারার অন্তরালে ভিতরে থাকে শক্ত মেরুদণ্ড। আদর্শ, অঙ্গীকার এবং একটু বা অহমিকা মিলে বেশ ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে এক মানুষ তিনি।
এরা সাধারণত নিশাচর। প্রচলিত কথা ছিল- সাংবাদিকের কপালে জোটে ঠাণ্ডা ভাত আর গরম বউ। কথাটা সত্যি ছিল এককালে। এখন দিন বদলেছে। তখনকার বাস্তবতায় বলতে হবে বস্তুত প্রকৃত সাংবাদিকের বউতো আসলে সতীন। সুয়োরানী তো সংবাদপত্র ও বউ হলো দুয়োরানী। অফিসে কিংবা খবরের খোঁজে সাংবাদিকের বেশির ভাগ সময় কেটে যায়। আদতে সাংবাদিকের জন্য স্বাভাবিক সংসারী জীবন মোটেও স্বাভাবিক নয়। ছা-পোষা সংসারী সাংবাদিক ডুমুরের ফুল, অমাবস্যার চাঁদ।
ফয়েজ আহমদ ব্রতধারী ঘরানার সাংবাদিক ছিলেন। তার বিখ্যাত বইয়ের নামই হলো ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’। বাংলাদেশের ইতিহাস কেবল ঘটনাবহুল নয়, নাটকীয় ঘটনায় ভরপুর। রাজনৈতিক নাটক জমে বেশি রাতে। ওরা যখন পেশা শুরু করেছেন তখনতো সংবাদপত্রের মূল কাজ হতো রাতেই। দিনে খবর সংগ্রহ, সন্ধ্যা থেকে মাঝরাত পর্যন্ত লেখা, তারপর ছাপা। বেশির ভাগ সময় ফিরতে হতো শেস রাতে পায়ে হেঁটে। প্রত্যেক পাড়ার ভরঘুরে কুকুরগুলো দল বেঁধে ঘেউ ঘেউ করে পিছু নিত, নিজ পাড়ার সীমানায় এসে অন্য পাড়ার কুকুরের জিম্মায় ফিরে ফিরে যেত। এভাবে চলতে চলতে কঠিন প্রতিক‚ল পরিস্থিতি সামলে চলায় অভ্যস্ত হয়ে যায় সর্বক্ষণই।
ফয়েজ ভাই রিপোর্টার, অতএব ভবঘুরে মানুষ, রাতজাগা মানুষ। কাজের সূত্রেই নানা মানুষের সংস্পর্শে আসেন, বিভিন্ন ঘটনায় জড়িয়ে যান। বিয়ে করেননি, সে হিসেবে সতীনের বালাই ছিল না। গল্প করতে ভালোবাসেন, আবার নিজেই গল্পের বিষয় হয়ে ওঠেন। কারণ বিচিত্র অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ তার জীবন।
আমরা যখন ১৯৮৬ সালে চট্টগ্রাম থেকে দৈনিক পূর্বকোণ প্রকাশ করি তখন সম্পাদক হিসেবে ঢাকা থেকে নিয়ে আসা হয় কে জি মুস্তাফাকে। আর কে জি ভাই ঢাকায় বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নেন তার বন্ধু ফয়েজ ভাইকে। তখন এরশাদের আমল। নানাভাবে বিরোধী দলগুলোর গণতান্ত্রিক আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছে। রাজনীতিতে ঘটনাবহুল দিন আর নানামুখী টানাপড়েন চলছে। আমাদের দেশের পাঠকরা তখন রাজনীতির খবর আর রাজনৈতিক গল্প শুনতে ভালোবাসতেন।
ফয়েজ ভাইয়ের কাজ ছিল প্রতিদিনই একটি করে পলিটিক্যাল স্টোরি বা রাজনৈতিক বিশ্লেষণ দেয়া। উনি লিখতেন না, প্রায় দিনই টেলিফোনে ডিক্টেশন দিতেন। দীর্ঘ লেখা এভাবেই এপাশে একজন শুনে লং হ্যান্ডে লিখে নিত। প্রায়ই লেখার পর ওকে আবার শুনাতে হতো। এভাবে দীর্ঘ ফোনালাপ চলত। মাঝে মাঝে দুই বন্ধু কে জি ভাই ও ফয়েজ ভাই ফোনে রসালাপ, হাসিঠাট্টাও চলত।
এসব কিংবদন্তি সাংবাদিকের জীবন ছকে বেঁধে চলেনি বটে, কিন্তু প্রচুর কাজ করেছেন তারা। বিশেষত জাতীয় জীবনের নানা ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। আসলে সাংবাদিককের নৈতিক অবস্থান ও আদর্শিক ভূমিকা দেশকে লক্ষ্যপথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। ফয়েজ ভাইয়ের গোছানো জীবন ছিল না বটে, কিন্তু অগোছানো জীবনটা ছিল ব্যক্তির জীবন, ভাবনা ও কর্মের জীবন ছিল গোছানো কারণ তা নিবেদিত ছিল সমষ্টির কাজে।
নাহ, তাঁদের কাছে সাংবাদিকতা নিছক জীবিকা ছিল না, এ ছিল জীবন- ব্যক্তি এবং জাতির। তাইতো তিনদলের রূপরেখা, দুই নেত্রীর সংলাপ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের কাজে কাণ্ডারির ভূমিকায় তাকে দেখা গেছে। জীবন কেবল সংবাদপত্রের পাতায় সীমাবদ্ধ ছিল না, ছড়িয়ে ছিল দেশে, ইতিহাসে, জনগণে, আন্দোলনে, সংগ্রামে। এভাবে রাজনীতিবিদ না হয়েও ফয়েজ ভাইরা ছিলেন রাজনীতির ভিতরেরই মানুষ, আবার সংস্কৃতির অন্দরমহলেরও খাস বাসিন্দা। তাঁর লেখায় মেলে সাহিত্যের স্বাদ।
বড়দের জগতের জটিল বিষয় নিয়ে ব্যস্ত মানুষটা অবসরে ছড়া লিখেছেন ছোটদের জন্য। অনেকের কাছে ফয়েজ ভাইয়ের ছড়াকার পরিচয়টাই হলো আসল। সাংবাদিক, যিনি কিনা মধ্যরাতের অশ^ারোহী, অবলীলায় ছড়া লিখেছেন ছোটদের জন্য।
এখন মনে হয় এই সব আড্ডাবাজ রংদার মানুষগুলো যেন সাংবাদিকতার জগৎ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এক একজন কে জি মুস্তাফা, ফয়েজ আহমদ হারিয়ে যাওয়া মানে সমাজ থেকে একজন করে বহুমুখী প্রাণবন্ত প্রভাবশালী মানুষের নিষ্ক্রমণ। এরা অসাম্প্রদায়িক উদার মুক্ত মনের মানুষ। এরা সমাজকে প্রাণবন্ত, স্বতঃস্ফূর্ত, সচল এবং ফলপ্রসূ করে তুলতে সাহায্য করেন। এদের সাহচর্য পেতে পারেন যে কোনো বয়সের সহকর্মী- ছোটবড় ভেদাভেদ ঘুচিয়ে দিয়ে মিশতে জানেন। আর তাতে সমাজের প্রাণপ্রবাহ অব্যাহত থাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। সত্যি, ফয়েজ ভাইদের অভাবে এই ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ে যাচ্ছে যেন। বিচ্ছিন্নতা, স্থবিরতা, বৃত্তাবদ্ধতা কিংবা বলা যায় আত্মকেন্দ্রিকতায় হারিয়ে যাচ্ছে সংবাদপত্র জগতের জলুস। ফয়েজ ভাইদের মতো মানুষের প্রাণে ছিল বহমান জীবনকে জলুসে রাঙিয়ে তোলার মতো অফুরন্ত ভাণ্ডার। তারা ছিলেন প্রকৃত জীবন-রসিক মানুষ।
কৃতজ্ঞতাঃ ভোরের কাগজ>>> শুক্রবার, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯