নিজস্ব প্রতিবেদক:
মন্দা কাটছে। চাঙ্গা হচ্ছে চট্টগ্রামের আবাসন খাত। ফ্ল্যাট, প্লট বেচাকেনা বাড়ছে। চাহিদা বৃদ্ধির সাথে আসছে নতুন অনেক প্রকল্প। নির্মাণ সামগ্রীসহ আবাসনে যুক্ত হরেক উপখাতে ব্যবসায় গতি এসেছে। রাজমিস্ত্রী থেকে শুরু করে উদ্যোক্তা সবাই কর্মব্যস্ত। এ খাতে টাকার প্রবাহ বেড়েই চলেছে। যার শুভ প্রভাবে সবল হচ্ছে জাতীয় অর্থনীতি। বাড়ছে সরকারের রাজস্ব আয়। চট্টগ্রাম অঞ্চলে ছোটবড় আবাসন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দেড়শ’। বিনিয়োগ কমপক্ষে ৬ হাজার কোটি টাকা। শ্রমঘন এ খাতে উদ্যোক্তা, ভুমি-মালি ক, কর্মী-শ্রমিকসহ জড়িত কয়েক লাখ মানুষ। করোনার ধকল কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে আবাসন খাত। আশাবাদী সবাই সুদিনের অপেক্ষা করছেন। সরকারের প্রণোদনা, বিনাশর্তে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ, কর্পোরেট কর হার আড়াই শতাংশ হ্রাস, কাঁচামালের উপর এক শতাংশ অগ্রিম কর কমানো হয়েছে। আগের তুলনায় প্লট-ফ্ল্যাট হস্তান্তরে স্বচ্ছতা বেড়েছে। জমি কিংবা ফ্ল্যাট বেচাকেনায় রেজিস্ট্রি, নামজারী জটিলতা কমেছে। কমেছে রেজিস্ট্রেশন ফি। চট্টগ্রামে গ্যাস, বিদ্যুৎ, ওয়াসার পানি, সড়ক যোগাযোগে দীর্ঘদিনের সমস্যা নিরসনের পথে।
এরফলে আবাসন খাতে বইছে সুবাতাস। উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন উদ্যোক্তা ও ক্রেতারা। নিজের জন্য স্বপ্নের ঠিকানা হাতের নাগালে ভাবছেন অনেকে। নগরীতে একখন্ড জমি সোনার চেয়েও দামি। ২০ বছরে ১০ থেকে ১৫ গুণ বেড়েছে। জমির অভাবে ঊর্ধ্বগামী হচ্ছে নতুন সব ভবন। বহুতল এপার্টমেন্ট ভবন ও ফ্ল্যাট কালচার বেড়েছে। তবে দুদক ও আয়কর বিভাগের আতঙ্ক কাটছে না অনেকেরই।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি আবদুল কৈয়ূম চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, করোনায় বেশ কয়েক মাস আবাসন খাত স্থবির থাকলেও এখন ফ্ল্যাট কেনাবেচা শুরু হয়েছে। নির্মাণ কাজে গতি এসেছে। চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম থেকে ফ্ল্যাট বিক্রি উল্লেখযোগ্যহারে বেড়েছে। এ খাতে গ্রাহকের বড় অংশই প্রবাসী উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাদের অবস্থা স্বাভাবিক হলে আবাসন খাত আরও চাঙ্গা হয়ে উঠবে।
চট্টগ্রামের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় রিয়েল এস্টেট স্যানমার-এর সিনিয়র নির্বাহী পরিচালক সেলিম বিন সালেহ বলেন, সরকারের নানা উদ্যোগে সুফল আসছে। ঘুরে দাঁড়াচ্ছে আবাসন খাত। ক্রেতারা বুকিং দিচ্ছেন। জমির মালিকরা উদ্যোক্তাদের সাথে চুক্তি করছেন। এ অবস্থা বজায় থাকলে খুব শিগগির ভালো অবস্থানে যাবে আবাসন শিল্প।
ফিনলে’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোফাখখারুল ইসলাম বলেন, গত কয়েক মাসে প্রায় ৫০ শতাংশ সচল হয়েছে আবাসন খাত। ক্রেতারা আসছেন। কিস্তির টাকা জমা দিচ্ছেন। প্রকল্প এলাকায় কাজ শুরু হয়েছে। নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবসা সচল হয়েছে। সব মিলিয়ে এ খাতে কর্মচাঞ্চল্য ফিরে আসছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলে ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়নে অনেক প্রকল্প চলমান। ফলে শিল্পায়নের পাশাপাশি আবাসন চাহিদা বাড়ছে। এ খাতে সরকারি সহযোগিতা বাড়লে উত্তরোত্তর সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাবে। জাতীয় অর্থনীতিতে আরও বেশি অবদান আশা করা যায়। চট্টগ্রামের মীরসরাই, সীতাকুন্ড ও ফেনী সোনাগাজীর বিস্তীর্ণ এলাকায় গড়ে উঠছে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর। সেই সাথে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মিত হলে কর্ণফুলী নদীর উভয় পাড়ে সাংহাইয়ের মতো চট্টগ্রাম হবে ‘ওয়ান সিটি- টু টাউন’। তখন আবাসন চাহিদা বাড়বে দ্বিগুণ।
কক্সবাজারে বহুমুখী গভীর সমুদ্রবন্দর, এনার্জি হাব, পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্র, ঢাকা-চট্টগ্রামের সঙ্গে সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপনের জন্য দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-ঘুনধুম-রেললাইন মেগা প্রকল্পসহ ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়ন হচ্ছে। ফলে আবাসনে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
ইউএনডিপি, গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), চসিক ও পরিবেশ অধিদফতরের জরিপ অনুসারে, চট্টগ্রাম মহানগরীতে বার্ষিক ৮ থেকে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে মানুষ। যোগ হচ্ছে অন্তত ৫০ হাজার বাসিন্দা। ফ্ল্যাটের চাহিদা দুই হাজার। কমপক্ষে ১২০ হেক্টর জমিতে আবাসন প্রয়োজন। সিডিএ প্রতিমাসে গড়ে ২শ’ থেকে আড়াইশ’ নতুন বাড়ি নির্মাণের প্ল্যান অনুমোদন করছে। জনসংখ্যার চাপ ও আবাসন চাহিদা সমানতালে বাড়ছে। ১৯৮৪ সালে নগরীর নাসিরাবাদে ‘আপন নিবাস’র হাত ধরেই চট্টগ্রামে আবাসন খাতের যাত্রা শুরু।
বর্তমানে নগর ও শহরতলী মিলিয়ে ২শ’ ২০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের চট্টগ্রামে জনসংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ। ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সমুদ্রবন্দর, শিল্প-কারখানা, পরিবহন, শিক্ষা, প্রশাসনিক কর্মকান্ডে সারাদেশ থেকে চট্টগ্রামমুখী জনস্রোত বাড়ছেই। নগরী ছাড়াও মীরসরাই, সীতাকুন্ড, পটিয়া, আনোয়ারা, হাটহাজারী ও কক্সবাজারে বিনিয়োগ-শিল্পায়নের গুরুত্বকে ঘিরে দেশি-বিদেশিদের জন্য বিশ^মানের আবাসন চাহিদা রয়েছে।
নগর পরিকল্পনাবিদগণ বলছেন, ‘প্রাচ্যের রাণী’ চট্টগ্রামের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও অপরূপ নিসর্গ সমুদ্র ও দীর্ঘ সৈকত, পাহাড়-টিলা, বন-জঙ্গল, নদ-নদী, হ্রদ, জলাশয়, দীঘি, পুকুর, খেলার মাঠ, খোলা জায়গা, পনি নিষ্কাশনের খাল-ছরা, নালা-নর্দমা ইত্যাদি সুরক্ষা প্রয়োজন। তাহলেই নগরায়নে ভারসাম্য আসবে। এরজন্য চট্টগ্রামের ২২টি সেবা দানকারী সরকারি সংস্থা ও বিভাগের মধ্যে দরকার সুষ্ঠু সমন্বয়। টেকসই আবাসন তথা নগরায়নে ক্রেতারা আকৃষ্ট হবেন বেশি। পানিবদ্ধতা, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহনশীল করে নির্মিত, মানসম্পন্ন ও পরিবেশবান্ধব আবাসন প্রকল্পে ক্রেতারা আগ্রহী।
রিহ্যাব নেতৃবৃন্দ জানান, চট্টগ্রাম ও পর্যটন শহর কক্সবাজারে আবাসন চাহিদা বাড়ছে। রিহ্যাবের সদস্য সংখ্যা ৮৩। ঢাকাভিত্তিক অন্তত ১০টি আবাসন প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামে কাজ করছে। এর পাশাপাশি আরও অর্ধশত ছোটবড় রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠান রয়েছে। নগরীর অভিজাত খুলশী, নাসিরাবাদ, পাঁচলাইশ, হালিশহর, কক্সবাজারের কলাতলী হোটেল-মোটেল জোনে অভিজাত ও দৃষ্টিনন্দন আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠেছে।
আবাসন খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট স্টিল ও আয়রন, সিমেন্ট, পাথর, বালু, টাইলস, প্লাস্টিক, সিরামিক সামগ্রী, ফিটিংস, আসবাবপত্র, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, রঙ থেকে শুরু করে সব খাত-উপখাতই কর্মচঞ্চল হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রাম অঞ্চলে স্যানমার, ইকুইটি, ফিনলে ছাড়াও সিপিডিএল, এপিক, জুমায়রা, র্যাঙ্কস এফসি, এয়ারবেল, এএনজেড, সাফসহ বেশ কয়েকটি আবাসন প্রতিষ্ঠান ভাল অবস্থানে আছে। নগরীর অভিজাত এলাকায় মানসম্মত ফ্ল্যাট হস্তান্তর করছে এএনজেড প্রপার্টিস।
প্রতিষ্ঠানের চট্টগ্রামের চীফ অপারেটিং অফিসার মো. মাহমুদুল হক বলেন, অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগ হওয়ায় এ খাতে টাকার প্রবাহ বেড়েছে। বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় নতুন নতুন প্রকল্প নেয়া শুরু হয়েছে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ বলেন, রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠানগুলো আবাসনের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণে কাজ করে যাচ্ছে। সিডিএ সর্বাত্মক সহযোগিতা দিচ্ছে। নতুন প্রকল্পের দ্রুত অনুমোদন দেয়া হচ্ছে।
ইস্ট ডেল্টা হোল্ডিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও রিহ্যাব চট্টগ্রাম অঞ্চলের সদস্য আবদুল গাফফার মিয়াজী বলেন, চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় মীরসরাই, আনোয়ারা, মহেশখালীসহ নতুন নতুন এলাকায় আবাসন প্রকল্প নেয়া হচ্ছে।
নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী এম আলী আশরাফ বলেন, জনসংখ্যার চাপ কমাতে এখনই নগরীর বাইরে বড় ধরনের আবাসন প্রকল্প নেয়া জরুরি। নিম্নবিত্তদের দিকে নজর দেয়ার সময় এসেছে। সরকারের সহযোগিতায় ‘ভাড়ার টাকায় বাড়ি’ এ নীতিতে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। চসিকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ এ কে এম রেজাউল করিম বলেন, প্লটের বদলে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেয়া হলে জমির অপচয় বন্ধ হবে।