রবিবার , সেপ্টেম্বর ২৯ ২০২৪
নীড় পাতা / উন্নয়ন বার্তা / আজকের বাংলাদেশ এবং শেখ মুজিবুর রহমান

আজকের বাংলাদেশ এবং শেখ মুজিবুর রহমান

নিউজ ডেস্ক:
‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ/ কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে/ সে কোলাহলের রুদ্ধস্বরের আমি পাই উদ্দেশ/ জলে ও মাটিতে ভাঙনের বেগ আসে। হঠাৎ নিরীহ মাটিতে কখন/ জন্ম নিয়েছে সচেতনতার ধান/ গত আকালের মৃত্যুকে মুছে/ আবার এসেছে বাংলাদেশের প্রাণ।’ হ্যাঁ, গত এক যুগের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় নতুন রূপে জেগে উঠেছে বাংলাদেশ। দুর্বার অগ্রযাত্রায় এই অদম্য বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু এর ভিত্তি দিয়ে গেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শাসনামলের সাড়ে তিন বছরে তিনি বাংলাদেশ পুনর্গঠনের জন্য যেসব উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেসবের বাস্তবায়নের মাধ্যমেই গড়ে উঠছে আজকের বাংলাদেশ।

ভিশন ২০২১; ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন; রূপকল্প ২০৪১- শব্দগুলো এখন প্রতিনিয়ত উচ্চারিত হয়। স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটেছে বাংলাদেশের। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নীতিসংক্রান্ত কমিটি (সিডিপি) ২০১৮ সালের ১৫ মার্চ এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে। মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে প্রায় সাড়ে তিন গুণ, বেড়েছে ক্রয়ক্ষমতা। জীবনযাত্রার মান বেড়েছে বহু গুণ। দেশে মাথাপিছু আয় বেড়ে ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় তা বছরে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৮৭৩ টাকা। মাথাপিছু আয়ের পাশাপাশি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পরিমাণও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ লাখ ৮৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।

অর্থনীতির এই যে ফুলে-ফেঁপে উঠা, তার নিরিখেই বাংলাদেশ চমকে দিচ্ছে বিশ্বকে। বিশ্ব নেতারাও উচ্ছ্বসিত বাংলাদেশের অব্যাহত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে। এটা কিভাবে সম্ভব হলো—অবাক বিস্ময়! অর্থনীতি তো আর ম্যাজিক নয়। জাদুদণ্ডের পরশে যার ভোল পালটানো যায় না। অনেক কষ্টে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠা। পিছলে পড়লে ফের উত্তরণের সংকল্প। বিশ্বব্যাংক, এশীয় ব্যাংক হতভম্ব। বলছে দেশটা করেছে কী!

ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে মানুষের জীবন হয়েছে আরামপ্রদ। বাংলাদেশের সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে গোটা বিশ্বব্যাপী। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে একে ‘উন্নয়নের মডেল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতির উদীয়মান এই অগ্রযাত্রাকে ‘স্টার অব ডিজেস্টার ম্যানেজমেন্ট’ বলছেন বিশ্বের অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরাও। নিউ ইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের ভাষায় এ দেশের অগ্রযাত্রা হলো—‘Standard bearer of South Asia। নিউইয়র্ক টাইমস-এর ‘Success in a land Known for Disasters’ শিরোনামের প্রবন্ধে বলা হয়েছে, নারী উন্নয়নে বাংলাদেশ যা করেছে, তা অন্য মুসলিম দেশের জন্য অকল্পনীয়; অবিশ্বাস্য।

এসব কী হুট করেই হয়েছে? মোটেও না। দেশ স্বাধীনের পরপরই দেশের সর্বোস্তরের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, তার দেখানো পথ ধরেই বাংলাদেশ আজ এই অবস্থায় পৌঁছেছে। রাজনীতি করতে গিয়ে গণমানুষের অঢেল ভালোবাসা পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু, তাই স্বাধীনতার পর আপামর জনতার জন্যই দেশকে গড়তে চেয়েছেন তিনি।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনি প্রচারে গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন বঙ্গবন্ধু। সে সময় প্রত্যন্ত এক গ্রামের এক বৃদ্ধা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। “আমি যে গ্রামেই যেতাম, জনসাধারণ শুধু আমাকে ভোট দেওয়ার ওয়াদা করতেন না, আমাকে বসিয়ে পানদানে পান এবং কিছু টাকা আমার সামনে নজরানা হিসেবে হাজির করতেন। না নিলে রাগ করতেন। আমার মনে আছে, খুবই গরিব এক বৃদ্ধ মহিলা কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, শুনেছে এই পথে আমি যাব, আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বলল, ‘বাবা, আমার এই কুঁড়েঘরে তোমায় একটু বসতে হবে।’ আমি তার হাত ধরেই তার বাড়িতে যাই। অনেক লোক আমার সঙ্গে, আমাকে একটা পাটি বিছিয়ে বসতে দিয়ে এক বাটি দুধ, একটা পান ও চার আনা পয়সা এনে আমার সামনে ধরে বলল, ‘খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছুই নাই।’ আমার চোখে পানি এলো। সেই দিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মানুষেরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না।” বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক মুক্তির পথে এটাই ছিল অর্থনৈতিক মুক্তির নীতি।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের প্রস্তুতির শেষ পর্যায় তখন। ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চেতনায় নতুন এক মাত্রা যোগ করে। একদিকে যেমন তিনি বুঝতে পারলেন, দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বাঙালি কতটা অসহায়, পাকিস্তান সরকার কতটা নির্বিকার, অন্যদিকে অনুভব করলেন, গরিব-দুঃখী মানুষগুলোর কী কষ্ট। তাই তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য চাই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনার কিছু অংশ তিনি প্রকাশ করলেন, ১৯৭০ সালের শেষ দিকে, পাকিস্তান টেলিভিশনে দেওয়া এক ইন্টারভিউয়ে, তার প্রাক-নির্বাচনি ভাষণে। সেদিনের ভাষণে তিনি এমনসব বিষয়ের অবতারণা করেছিলেন, যার সঙ্গে গণমানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের সরাসরি যোগ ছিল। তিনি শুরুতেই একচেটিয়াবাদ ও কার্টেলের বিরুদ্ধে মুখ খুললেন। বললেন, ভূমি-সংস্কার না করার ফলে দরিদ্র কৃষকদের অবস্থা দিন দিন আরো খারাপ হচ্ছে। ৯০ লাখ শ্রমজীবী মানুষ বেকার। পাশাপাশি তিনি তুলে ধরেন অর্থনৈতিক বৈষম্যের ভয়াবহ এক চিত্র। গ্রামাঞ্চলে প্রায় দুর্ভিক্ষাবস্থার কথা জানালেন। আর বললেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে তিনি কী কী করবেন। বৈষম্য দূর করবেন। সমবায় সমিতি গড়ে তুলবেন। শিল্পের প্রসারে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পকে গুরুত্ব দিবেন। কৃষি ব্যবস্থা সংস্কার করবেন। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করে দিবেন। গ্রামে গ্রামে বিজলিবাতি দিবেন। পুঁজি বিনিয়োগ করবেন শিক্ষা খাতে। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বাসগৃহ নির্মাণ করবেন। প্রতি ইউনিয়নে পল্লি চিকিত্সাকেন্দ্র খুলবেন। অর্থনীতির সর্বক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে সবকিছুর পুনর্বিন্যাস করবেন। নয়া মজুরি কাঠামো তৈরি করবেন। জনগণের সরকার কায়েম করবেন।

১৯৭০-এর সেই ঐতিহাসিক নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তার দল স্মরণকালের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হয়। জাতীয় পরিষদের বৈঠক বাতিল করা হয়। তীব্র প্রতিবাদে গর্জে উঠে সমগ্র বাঙালি জাতি। বঙ্গবন্ধু জনতার ক্রোধ ও স্বাধিকারের প্রত্যয়কে ধারণ করে জাতিকে স্বাধীনতার সংগ্রামের পথে এগিয়ে নেন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণে তিনি বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো’।

এই কণ্ঠ কাঁপিয়ে দিয়েছিল সমগ্র দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষকেও। সমগ্র দেশবাসী এ ভাষণ শুনে শিহরিত হয়েছেন। সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছেন, বাংলাদেশ আর পাকিস্তানে গণ্ডিবদ্ধ নেই। আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতাপ্রাপ্তি সময়ের ব্যাপার মাত্র। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে এলো স্বাধীনতার ঘোষণা। বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন স্বাধীনতার জন্য জাগ্রত জাতির ঐক্যের প্রতীক। স্বাধীনতার স্থপতি। জাতির জনক। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের আকাশে পতপত করে উড়ল লাল সবুজের নতুন পতাকা। দেশ হয় হানাদার মুক্ত।

১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন স্বদেশের মাটিতে পা রাখেন। শুরু করলেন অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা। তার অর্থনৈতিক আদর্শ ও কৌশল ছিল নিজস্ব সম্পদের উপর দেশকে দাঁড় করানো। এক ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি সোনার বাংলা গড়ে তোলার ঘোষণা দিলেন। অঙ্গীকার অনুযায়ী মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই একটি সংবিধান দিলেন। সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের কথা লেখা আছে সেখানে। ঘোষণা করলেন প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, যার মূল লক্ষ্য ছিল সম্পদের সামাজিকীকরণ। দেশ-বিদেশে অবস্থানরত শ্রেষ্ঠ বাঙালি মেধার সম্মিলন ঘটালেন তিনি পরিকল্পনা কমিশনে। যাত্রাতেই বললেন, ‘আমাদের চাষিরা হলো সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেণি। তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য আমাদের উদ্যোগের বিরাট অংশ অবশ্যই তাদের পেছনে নিয়োজিত করতে হবে।’

আরও দেখুন

গাছের সাথে বেঁধে নির্যাতন-আসামি গ্রেফতারে অনীহা পুলিশের

নিজস্ব প্রতিবেদক, বাগাতিপাড়া:নাটোরের বাগাতিপাড়ার কৈচরপাড়া গ্রামে গাছের সাথে বেঁধে মধ্যযুগীয় কায়দায় মারপিট করে নির্যাতন ও …