নিউজ ডেস্ক:
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যাপকভাবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের পরিকল্পনা নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ ক্ষেত্রে কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন বিদায়ী নির্বাচন কমিশন প্রায় ১০০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তুতি রেখে যাচ্ছে। তবে সরকার চাইলে সংসদের ৩০০ আসনেই ইভিএমে ভোট গ্রহণ করবে নির্বাচন কমিশন। বর্তমান ইসি ১৪ ফেব্রুয়ারি বিদায় নেবে। এরপর দায়িত্ব নেবে নতুন কমিশন। তাদের অধীনেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে।
ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে বা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে। বর্তমানে ইসির হাতে যে পরিমাণ ইভিএম সংরক্ষিত আছে তা দিয়ে প্রায় ১০০ আসনে ভোট গ্রহণ করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ৩০০ আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হলে সে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য ইসির হাতে এখন পর্যাপ্ত সময় রয়েছে।
বিগত একাদশ সংসদ নির্বাচনে ছয়টি আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনে এর ব্যবহারের সূচনা হয়। বিভিন্ন স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে ইভিএমে ভোট গ্রহণের সাফল্যের পর বিদায়ী ইসি আগামী সংসদ নির্বাচনে ব্যাপকভাবে এর ব্যবহারের প্রস্তুতি রেখে যাচ্ছে। তবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে কতটি আসনে ইভিএম ব্যবহার হবে তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক ঐকমত্য ও নতুন নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের ওপর।
ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বিগত একাদশ সংসদ নির্বাচনে দেশে ভোট কেন্দ্র ছিল ৪০ হাজার ১৮৩টি। ভোটকক্ষ ছিল ২ লাখ ৭ হাজার ৩১২টি। এ প্রক্রিয়ায় ভোট গ্রহণ করতে প্রতি ভোটকক্ষের জন্য একটি ইভিএম প্রয়োজন হয়। যান্ত্রিক ত্রুটি বিবেচনায় রেখে প্রতি কেন্দ্রের জন্য মোট কক্ষের অর্ধেকসংখ্যক ইভিএম অতিরিক্ত সংরক্ষণ করা হয়। সে হিসাবে ৩ লাখ ১০ হাজার ৯৬৮টি ইভিএম প্রয়োজন হবে ২ লাখ ৭ হাজার ৩১২টি ভোটকক্ষের জন্য। তবে প্রতি বছরে ২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে দেশে ভোটার বাড়ছে এবং পাঁচ বছরে প্রায় ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ ভোটার বাড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্র ও ভোটকক্ষের সংখ্যাও বাড়বে আগামী সংসদ নির্বাচনে। ইসির প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে ভোট গ্রহণের জন্য ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ ইভিএমের প্রয়োজন হবে।
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সক্ষমতার বিষয়ে জানতে চাইলে ইসির আইডিয়া প্রকল্পের (দ্বিতীয়-২) প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল কাশেম মো. ফজলুল কাদের গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের হাতে বর্তমানে ১ লাখ ৫২ হাজার ৫৩৫টি ইভিএম রয়েছে। তা দিয়ে প্রায় ১০০ আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণের সক্ষমতা রয়েছে। যদিও বর্তমানে যে পরিমাণ ইভিএম আছে তা দিয়ে ১০০-এর বেশি আসনে ভোট গ্রহণ সম্ভব হতো। কিন্তু দেশে প্রতি বছর ২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে ভোটার বাড়ছে। সে হিসাবে বিগত সংসদ নির্বাচন থেকে আগামী সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত পাঁচ বছরে প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশ ভোটার বাড়বে। তাই বর্তমানে যে পরিমাণ ইভিএম আমাদের হাতে রয়েছে তা দিয়ে আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রায় ১০০ আসনে ভোট গ্রহণের সক্ষমতা থাকবে।’
ইভিএম ব্যবহারে দক্ষ জনশক্তি তৈরি বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক আবদুল বাতেন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের হাতে দেড় লাখের বেশি ইভিএম রয়েছে। তাই দেড় লাখ ইভিএম ব্যবহারের জন্য দক্ষ জনশক্তি প্রস্তুত করার পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের প্রতিটি উপজেলায় ৫০ জন করে ইভিএম ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সব মিলে দেশে প্রায় ৫০ হাজার ব্যক্তিকে ইভিএম ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আগামীতে ইভিএম ব্যবহারে দক্ষ জনশক্তি তৈরির কাজ হাতে নেওয়া হবে।’
ইসির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী সব নির্বাচনেই ইভিএম ব্যবহারের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। বর্তমানে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ সংসদ নির্বাচনে পরীক্ষামূলকভাবে ছয়টি আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণ করে সফলতা পায় ইসি। এরপর উপজেলা ও পৌরসভা নির্বাচনে ব্যাপক ব্যবহারে যায় কমিশন। মাঝে বেশ কয়েকটি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচন, সিটি নির্বাচনেও ইভিএমে ভোট নেওয়া হয়। সবশেষ ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে পুরোপুরি ইভিএমে ভোট গ্রহণ করা হয়। ৩১ জানুয়ারি ২১৯ ইউপিতে পুরোপুরি ইভিএমে ভোট গ্রহণ করবে কমিশন। এ ছাড়া ইউপি নির্বাচনের প্রতি ধাপে বেশ কিছু ইউপিতে ইভিএমে ভোট হয়। ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, ইভিএম প্রকল্পের আওতায় দেড় লাখ ইভিএম কেনা হয়েছে (মূলত এগুলো একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগেই কেনা হয়েছিল)। তার মধ্যে ৮২ হাজার মেশিন মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন নির্বাচনে ব্যবহারের জন্য পাঠানো হয়েছে। ৩৪ হাজার ইভিএম মেশিন তাদের কাছে রয়েছে। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরে আরও ইভিএম কেনার পরিকল্পনা রয়েছে। এদিকে ইভিএম পরিচালনায় দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে কারিগরি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। ইসির এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ইভিএম ব্যবহারে পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট এবং স্কুল-কলেজের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে দক্ষ শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে প্রস্তুত করা হবে। এর আগে ২০২০ সালের জুনেও কিছু শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয় নির্বাচন কমিশন। তবে সেখানে কারিগরি শিক্ষকরা ছিলেন না। স্কুল-কলেজের আইসিটি শিক্ষকদের মধ্যে যারা দক্ষ প্রতি উপজেলায় এমন ১০ জন করে মোট ৫ হাজার ১৯০ জন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল।
২০১০ সালের ১৭ জুন দেশে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ শুরু করে বিগত ড. এ টি এম শামসুল হুদা নেতৃত্বাধীন কমিশন। পরে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন কমিশন রাজশাহী সিটি নির্বাচনে ২০১৫ সালের ১৫ জুন ভোট নিতে গেলে একটি মেশিন বিকল হয়ে পড়ে। সেই মেশিন পরে আর ঠিক করতে পারেনি কমিশন। ওই মেশিনগুলো নষ্ট করে নতুনভাবে আরও উন্নত প্রযুক্তির ইভিএম তৈরির নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন তারা। কে এম নূরুল হুদার বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় নতুন ইভিএম সংগ্রহ করে। এজন্য হাতে নেওয়া হয় একটি প্রকল্প। সে প্রকল্পের অধীনে বর্তমানে ইভিএম সংগ্রহ চলছে। ইসির এক কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, ইভিএম প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৮২৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।