শুক্রবার , নভেম্বর ১৫ ২০২৪
নীড় পাতা / জাতীয় / আগামী এক বছরে ১০ লাখ কর্মী বিদেশে পাঠানোর টার্গেট

আগামী এক বছরে ১০ লাখ কর্মী বিদেশে পাঠানোর টার্গেট

  • অর্থনীতি চাঙ্গা করতে শ্রমবাজারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার

আগামী এক বছরে কমপক্ষে দশ লাখ লোক বিদেশ যাবে। করোনা মহামারীতে ধাক্কা খাওয়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে শ্রমবাজারকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এরই মধ্যে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চালু করার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। এখন চলছে শ্রমিক নিবন্ধনের কাজ। জনশক্তি রফতানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক বছরে দশ লাখ লোক বিদেশে পাঠানো বিলাসী স্বপ্ন নয়। এটা বাস্তবায়নযোগ্য। আগামী বছর হবে শ্রমবাজারের নতুন অধ্যায়। কেননা চলতি অর্থ বছরে-(জুলাই থেকে জুন) দশ লাখের টার্গেট পূরণ হওয়ার পথে। মধ্যপ্রাচ্যের স্থায়ী শ্রমবাজারের পাশাপাশি বন্ধ থাকা দেশগুলো খোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বাহরাইন ঘোষণা দিয়েছে, খুব শীঘ্রই বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেয়ার জন্য ভিসা প্রদান শুরু করা হবে। এছাড়া নতুন নতুন শ্রমবাজার আবিষ্কার করারও পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। রুমানিয়া পোল্যান্ড ও বলিভিয়াসহ ইউরোপে বৈধভাবে শ্রমিক পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মালদ্বীপে থাকা অবৈধ শ্রমিকদের বৈধতা দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় দেশটিতে উল্লেখযোগ্য শ্রমিক পাঠানোর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এসব মিলিয়ে এবার টার্গেট পূরণের নতুন মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। 

জনশক্তি রফতানি এজেন্সিগুলো জানিয়েছে, আগামী অর্থ বছর হবে সব দিক থেকেই উজ্বল সম্ভাবনার। একদিকে করোনার ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার জন্য গোটা বিশ্বে যেভাবে অর্থনীতি চাঙ্গা করার ওপর জোর দিয়েছে, তাতে উন্নত দেশগুলো সস্তা দরে শ্রমিক নেয়ার ওপর জোর দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। আবার বাংলাদেশও এখাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। বাজেট অধিবেশনের আগে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামালও আগামী এক বছরে কমপক্ষে দশ লাখ শ্রমিক বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। এখন সেটা বাস্তবায়নের জন্য সরকার বদ্ধপরিকর। তবে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ অভিবাসন ব্যবস্থার ওপর। এ জন্য ম্যানুয়ালের পরিবর্তে যত বেশি ডিজিটালাইজেশন করা হবে- তত বেশিই অভিবাসন খাতে আরও স্বচ্ছতা ফিরে আসবে। তবেই সম্ভব এখন থেকে ঠিক আগামী এক বছরে দশ লাখেরও বেশি শ্রমিক পাঠানো।

এদিকে জনশক্তি রফতানি প্রশিক্ষণ ব্যুরো জানিয়েছে, সরকার নতুন বাজার খোঁজার পাশাপাশি বন্ধ থাকা শ্রমবাজারগুলোকে চালু করার কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। তারই ফলস্বরূপ বাহরাইনের শ্রমবাজার দীর্ঘ চার বছর পর চালু হতে যাচ্ছে। দেশে এসে আটকেপড়া বাংলাদেশী কর্মীরা আবারও সেখানে যাওয়ার সুযোগ পাবেন। সম্প্রতি দেশটিতে থাকা বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নজরুল ইসলাম এক ফেসবুক লাইভে এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, করোনা মহামারীর মধ্যে দেশে এসে আটকেপড়া ১৬১ জনকে প্রথম দফায় ভিসা দেয়া হবে বলে জানিয়েছে বাহরাইন সরকার। বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাহরাইন সরকার ২০১৮ সালে বাংলাদেশীদের নতুন করে ভিসা দেয়া বন্ধ করে দেয়। এ কারণে যারা করোনা মহামারীকালে দেশে এসেছিলেন, তারাও ফিরতে পারছিলেন না কর্মস্থলে। এ সমস্যা সমাধানে বাহরাইন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে বাংলাদেশ সরকার ও সেখানে থাকা দূতাবাস। এতে মানামার ইতিবাচক ইঙ্গিত মিললে ফিরতে ইচ্ছুক প্রবাসীদের নিবন্ধন করতে বলা হয়। রাষ্ট্রদূত নজরুল ফেসবুক লাইভে বলেন, বাহরাইনে ফেরার জন্য ৯৬৭ জন নিবন্ধন করেছিলেন। তাদের মালিকপক্ষ ফিরিয়ে নিতে রাজি আছেন। মালিকপক্ষের সাড়া পাওয়ার ওপর ভিত্তি করে ১৬১ জনের নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রথমে বাহরাইনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘ভিজিট ভিসা ইস্যু করবে। এরপর বাহরাইনে গেলে তাদের নিয়োগকর্তার মাধ্যমে ওই ভিসাকে ওয়ার্ক ভিসায় রূপান্তর করা যাবে।

বিদেশের শ্রমবাজার চাঙ্গা করার ইস্যুতে জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রাণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, এক সময় অনেক দেশে বৈধভাবে কর্মসংস্থানের জন্য বাংলাদেশী শ্রমিক যেত। কিন্তু গত কয়েক বছরে সেই বাজার অনেকটাই সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। তার ওপর করোনা মহামারীতে গোটা বিশ্বে শ্রমবাজার আরও চাপে পড়ে। অথচ বাংলাদেশের শ্রমবাজারটি গোটা দুনিয়াজুড়ে বিস্তৃত। বিশ্বের ১৭২টি দেশে বৈধভাবে কাজ নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশীরা। বছরে গড় পড়তায় বাংলাদেশে থেকে সরকারীভাবেই আট থেকে ১০ লাখ শ্রমিক বিদেশে যান। এদের বেশিরভাগই যান অদক্ষ শ্রমিক হিসাবে। তবে অন্যান্য ভিসা মিলিয়ে ২০ লাখের বেশি কর্মী বিদেশে যান।

এদিকে নতুন অর্থবছরে কিভাবে এ টার্গেট পূরণ করা সম্ভব এমন প্রশ্নের জবাবে বিএমইটি মহাপরিচালক শহিদুল আলম বলেন, করোনার সময়ে মাত্র ২ লাখ ৭১ হাজার লোক বিদেশে গেছেন। তারপরের বছর অর্থাৎ চলতি বছর টার্গেট ছিল ৪ লাখ। সে লক্ষ্য অতিক্রম করে দশ লাখ ছুঁই ছুঁই। এটা সম্ভব হয়েছে প্রধানত তিন কারণে। প্রথমত, গণহারে টিকা প্রদান, দ্বিতীয়ত বিএমইটি পদ্ধতি সহজীকরণ ও তৃতীয়ত প্রবাসী গমনেচ্ছুদের ৭০০ কোটি টাকা লোন প্রদান। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এ খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শ্রমিকদের জন্য বিদেশমুখী করার নানাবিধ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যেমন আগে রোমানিয়ার ভিসা নিতে হতো দিল্লী থেকে। এখন এটা কাকরাইলের জনশক্তি অফিসেই ভিসা কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। জাপান ও কোরিয়া যাওয়ার প্রশিক্ষণ সুবিধা প্রদানের কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। সারাদেশের যুব সমাজকে বিদেশ যাওয়ার আগে ন্যূনতম মৌলিক প্রশিক্ষণ প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। এ ছাড়া কোন রিক্রুটিং এজেন্সি যাতে শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানোর নামে কোন অঙ্গীকার বা প্রতারণা করতে না পারে সেজন্য তাদের আইনের আওতায় আনার বিষয়টি সহজ করা। এতে স্বচ্ছতা ফিরে আসছে। অর্থাৎ স্বচ্ছ অভিবাসন পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সেটা আরও জোরদার করা হবে। কাজেই আগামী এক বছরে মালয়েশিয়া চালু হলে সেটা ১২ লাখ ছাড়িয়ে যাবে।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের শ্রমবাজারের ৮০ শতাংশের বেশি মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক। মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর মিলিয়ে রয়েছে ১৫ শতাংশের মতো। অবশিষ্ট বাজার নানা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এর বাইরে নতুন শ্রমবাজার উন্মোচনের লক্ষ্যে নেয়া হয়েছে নানামুখী পদক্ষেপ।

জানা গেছে, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। তারপরই রয়েছে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর। সৌদির পর মধ্যপ্রাচ্যের অন্য শীর্ষ দেশগুলো হচ্ছে- সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, বাহরাইন ও জর্ডান। এক সময় কিছু শ্রমিক অবৈধভাগে গেলেও এখন বৈধভাবে পোল্যান্ড, রোমানিয়া বলিভিয়ায় বাংলাদেশী শ্রমিকরা সম্প্রতি যেতে শুরু করেছে। এ সব দেশে দক্ষ ও অদক্ষ সব ধরনের শ্রমিকই যাচ্ছেন। বায়রার সাবেক সভাপতি আবুল বাশার বলেন, এখন শুধু সৌদি আরবেই প্রতি মাসে গড়ে ১ লাখ ২০ হাজার লোক যাচ্ছে। কারণ এটা আমাদের সবচেয়ে বড় বাজার। এখানে যাওয়া শ্রমিকদের বেশিরভাগই অদক্ষ শ্রমিক। তারা নির্মাণ খাত, রেস্তরাঁ, দোকান ও রাস্তাঘাটে ক্লিনারের কাজে যাচ্ছেন। আবার অনেকে ভ্রমণ ভিসায় বা স্বজনদের সঙ্গে দেখা করার ভিসায় গিয়ে নানা দেশে থেকে যাচ্ছেন। অনেকে কাজের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও অবৈধভাবে অবস্থান করতে বাধ্য হন।

এদিকে বাংলাদেশীদের জন্য শীর্ষ শ্রমবাজার হচ্ছে সৌদি আরব ওমান, সিঙ্গাপুর, কাতার, জর্ডান, মরিসাস ও কুয়েত। সৌদি আরবে প্রতিমাসে এক লাখের বেশি দক্ষ অদক্ষ শ্রমিক যাচ্ছেন। আবার বিশ্বকাপ সামনে রেখে কাতারে জোরেশোরে নির্মাণ কাজ চলছে। সেখানেও প্রচুর বাংলাদেশী শ্রমিক যাচ্ছেন। আবার একসময় বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য শ্রমিক কুয়েতে কাজ করতে গেলেও এখন সেখানে কর্মীদের যাওয়া অনেক কমে গেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে কম হলেও সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, লেবানন, লিবিয়া সুদান, মালয়েশিয়া দক্ষিণ কোরিয়া, ইটালি, মিসর, ব্রুনেই, জাপান, ইরাক ও যুক্তরাজ্যে দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিকরা যাচ্ছেন। অবশ্য এসব দেশে দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এক কোটিরও বেশি প্রবাসী মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশের অর্থনীতিকে দুঃসময় চাঙ্গা রেখেছেন। এখনও সচল রাখছেন। সেজন্য চলতি বছর বিদেশের শ্রমবাজার আরও নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য করার জন্য এবার সরকার আগের চেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে- জনশক্তি রফতানিই এখন জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি। রেমিটেন্স দেশের অর্থনীতির একটি বড় শক্তি। করোনা মহামারীর সময়ও এটা খুব ভালভাবেই বোঝা গেছে। তখন বিশ্বজুড়েই অর্থনীতি চাপের মুখে ছিল। বাংলাদেশও এর বাইরে ছিল না। ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছিল, শিল্প ও কল-কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হয়েছিল। তখন মূলত দুটি খাতের ওপর ভিত্তি করে দেশের অর্থনীতি টিকে ছিল। একটি হলো কৃষি, অন্যটি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। দেশবাসী দেখেছে- কিভাবে মহামারীর মাঝেও প্রবাসীরা হাত খুলে দেশে ডলার পাঠিয়েছেন। এ সময় তাদের পাঠানো আয় অর্থনীতিকে দিয়েছে বড় স্বস্তি। প্রবাসী আয়ের ওপর ভর করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উঠেছে নতুন উচ্চতায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবাসী আয় এসেছে ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ ডলার। এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রবাসীরা পাঠিয়েছিলেন ১ হাজার ৮০৩ কোটি ১০ লাখ ডলার। দেশের অনেক পরিবারে করোনার দুর্যোগকালে স্বস্তি ও সাহস জুগিয়েছে এ প্রবাসী আয়ের অর্থ।

এ সব বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, বিদেশে শ্রমবাজার নিয়ে সরকার সর্বদাই সক্রিয়। এ বছর দশ লাখ লোক পাঠানোর ঘোষণা বাস্তবায়নযোগ্য। এটা সম্ভব। মালয়েশিয়াসহ বন্ধ থাকা মার্কেটগুলো সবাই খুলতে বলছে। আমিও চাই। সেভাবে কাজও চলছে। আমাদের তো মার্কেট খোলার পাশাপাশি নিরাপদ রাখার বিষয়টিও বিবেচনা করতে হয়। কারণ ইস্যু হচ্ছে আমার জাতীয় স্বার্থ।

এদিকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের জন্য নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় শুরু হওয়ায় জনশক্তি রফতানি এজেন্সিগুলো সক্রিয় হয়ে উঠেছে। যদিও আপাতত ২৫ সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই শ্রমিক নেয়া হবে বলে গুঞ্জন রয়েছে। তারপরও অন্তত কমপক্ষে ৩ শত রিক্রুটিং এজেন্সি শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হবে। তারা ইতোমধ্যে দেশজুড়ে শ্রমিক সংগ্রহের কাজে লোক নিয়োগ করেছে।

আরও দেখুন

চাঁপাইনবাবগঞ্জে ‘রক্তের খোঁজে আমরা’র ২য় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত

নিজস্ব প্রতিবেদক চাঁপাইনবাবগঞ্জ ………..চাঁপাইনবাবগঞ্জে রক্তদান সামাজিক সেবামূলক সংগঠন ‘রক্তের খোঁজে আমরা’র ২য় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হয়েছে। শুক্রবার …