নিজস্ব প্রতিবেদক:
ফ্রান্সে রাষ্ট্রীয় মদদে ‘ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শনের’ মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের ঘটনায় বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন রাজপথে ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে। এরই মধ্যে হেফাজতে ইসলাম সোমবার ফ্রান্সের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করাসহ ৩ দফা দাবিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে। সরকার কৌশলে এ উত্তপ্ত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেও রাষ্ট্রবিরোধী একাধিক ষড়যন্ত্রকারী চক্র নানা গুজব ছড়িয়ে দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে বলে গোয়েন্দারা আশঙ্কা করছেন। উদ্বেগজনক এ পরিস্থিতিতে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
তবে ফ্রান্সবিরোধী চলমান মিছিল-সমাবেশ নিয়ের্ যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব বাহিনী সহিষ্ণু আচরণ প্রদর্শন করবে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে ফ্রান্স দূতাবাস, অঁলিয়স ফ্রঁসেস ও ফ্রান্স ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। দেশে অবস্থিত ফ্রান্স নাগরিকদের নিরাপত্তাব্যবস্থাও জোরদার করা হয়েছে। একই সঙ্গে ফ্রান্স ইসু্যতে প্রতিবাদ সমাবেশ ও মিছিলসহ সব ধরনের কর্মসূচির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সর্বোচ্চ সতর্ক থাকবে।
এদিকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার এ স্পর্শকাতর ইসু্যতে দেশি-বিদেশি কোনো বিশেষ চক্র যাতে কোথাও কোনো ষড়যন্ত্রের জাল বিছাতে না পারে এজন্য সরকার সব গোয়েন্দা সংস্থাকে তৎপর থাকার নির্দেশ দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় তারা সন্দেহভাজন ব্যক্তি, সংগঠন ও বিশেষ গোষ্ঠীর ওপর কড়া নজর রাখতে শুরু করেছে। সন্দেহভাজনদের মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং ও তাদের গতিবিধি সার্বক্ষণিক মনিটর করা হচ্ছে।
অন্যদিকে ফেসবুক ও টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার গুজব ছড়িয়ে কোনো বিশেষ চক্র যাতে দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে না পারে সে বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। এজন্যর্ যাব-পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সাইবার ইউনিটগুলোকে সতর্ক করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বড় বড় গ্রম্নপগুলোকে গোয়েন্দা নজরদারিতে এনেছে। ধর্মবিদ্বেষী ও আক্রমণাত্মক কোনো পোস্ট দেখামাত্রই
সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তা মুছে দেওয়ার অনুরোধ জানানো হচ্ছে। প্রয়োজনে এ ধরনের উসকানিমূলক পোস্টদাতাদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানোর প্রস্তুতিও রাখা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ফ্রান্স ইসু্যতে বিক্ষুব্ধ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে অপব্যবহার করে একটি চক্র গত ২৯ অক্টোবর লালমনিরহাটে মসজিদে পবিত্র কোরআন শরীফ অবমাননার গুজব ছড়িয়ে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা ও মরদেহ আগুনে পোড়ানোর ঘটনা ঘটিয়েছে। যদিও পরে ওই ব্যক্তি ধার্মিক ছিলেন বলে স্থানীয়রা নিশ্চিত করেছেন। এ ঘটনার পর ৪৮ ঘণ্টা পার না হতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়িয়ে কুমিলস্নার মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরা থানার ৪নং পূর্ব ধইর ইউনিয়নের কোরবানপুর গ্রামে স্থানীয় এক দল বাসিন্দা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, গুজব ছড়িয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির অপচেষ্টা এর আগেও হয়েছে। তাই আর যাতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে জন্য তারা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) মো. সোহেল রানা বলেন, গুজব রটনাকারী যে-ই হোক ছাড় দেওয়া হবে না। সবাইকে ধর্মবিদ্বেষী ও উসকানিমূলক পোস্ট শেয়ার না করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এই সময়ে গুজবে কারও কান দেওয়া ঠিক হবে না। কোনো পোস্ট শেয়ার করার আগে তথ্যের সত্যতা যাচাই করা দরকার।
এদিকে ঢাকায় ফ্রান্স দূতাবাসসহ দেশটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো ঘিরে বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ। সোমবার থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত পুলিশের এই বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা কার্যকর থাকবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্র জানায়, ঢাকায় ফ্রান্স দূতাবাসটির অবস্থান গুলশানের কূটনীতিক পাড়ায়। এলাকাটিতে বিভিন্ন দেশের দূতাবাস ও বিদেশিদের চলাচল বেশি থাকায় সেখানকার নিরাপত্তার জন্য ডিপেস্নামেটিক সিকিউরিটি পুলিশ রয়েছে। তবে চলমান ফ্রান্সবিরোধী মিছিল ও সমাবেশকে কেন্দ্র করে এসব এলাকায় ডিপেস্নামেটিক সিকিউরিটি পুলিশের পাশাপাশি থানা পুলিশও বিশেষ টহল টিম নিয়োজিত রয়েছে।
গুলশান থানা সূত্র জানায়, ডিপেস্নামেটিক জোনে পুলিশের একজন সহকারী কমিশনারের পাশাপাশি পরিদর্শক (অপারেশন) সেখানকার নিরাপত্তাব্যবস্থা সার্বক্ষণিক তদারকি করবেন। তাদের সঙ্গে থাকবেন দুজন করে পুলিশ উপ-পরিদর্শক (এসআই) এবং সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই)। পোশাকের পাশাপাশি সাদা পোশাকে মোটরসাইকেলে করে দুজন এসআই এবং দুজন এএসআই ফ্রান্স দূতাবাসের চারপাশে ডিউটি করবেন। এর বাইরে দূতাবাস ঘিরে ডিপেস্নামেটিক সিকিউরিটি পুলিশ নিয়মিত টহল দেবে।
দূতাবাসের পাশাপাশি অঁলিয়স ফ্রঁসেজ গুলশান শাখায় একজন এসআই এবং একজন এএসআই দায়িত্ব পালন করছেন। তদারকির দায়িত্বে রয়েছেন খিলক্ষেত থানার পরিদর্শক (অপারেশন)। এছাড়াও বাড্ডা লিংক রোডের বৌদ্ধ মন্দিরের সামনে ২ জন করে এসআই এবং এএসআই ডিউটি পালন করছেন। তাদের তদারকির দায়িত্বে রয়েছেন বাড্ডা থানার পরিদর্শক (তদন্ত)। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত ফ্রান্সের বিভিন্ন স্থাপনা ঘিরেও পুলিশ বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট জোনের ডিসি, এডিসি, এসি (জোন/প্যাট্রোল), ওসি ও পিআই সেখানে নিয়োজিত মাঠপর্যায়ের অফিসার ও ফোর্সের ডিউটি তদারকি করবেন।
এছাড়া ফ্রান্স ইসু্যতে কোনো মিছিল, বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে লালবাগ, ওয়ারী, মিরপুর, তেজগাঁও ও উত্তরা জোনে ২ পস্নাটুন করে ফোর্স থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এসব জোনের ডিসি সুবিধাজনক স্থানে তাদের মোতায়েন করবেন। এসএএফ, পিওএম পূর্ব-উত্তর-দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে এ ফোর্স দেওয়া হবে।
ডিপেস্নামেটিক সিকিউরিটি বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. আশরাফুল ইসলাম যায়যায়দিনকে জানান, ফ্রান্স ইসু্যতে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল হচ্ছে। এসব কর্মসূচির নেতিবাচক প্রভাব যাতে ডিপেস্নামেটিক জোনে না পড়ে, তার জন্য বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বিশেষ করে ফ্রান্স দূতাবাস ও তাদের বিভিন্ন স্থাপনার চারপাশে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। সাদা পোশাকে গোয়েন্দারাও তৎপর রয়েছেন।
এদিকে ঢাকার বাইরে দেশের প্রতিটি জেলাতেও নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার পাশাপাশি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানাসংক্রান্ত বিভিন্ন গুজব ঠেকাতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পুলিশের প্রত্যেক সার্কেল অফিসার (এএসপি) অধীনে থাকা প্রতিটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) সঙ্গে এ ব্যাপারে নিয়মিত মিটিং করবেন। গুজব এবং গণপিটুনির বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরির ব্যাপারে তারা সর্বোচ্চ সচেষ্ট থাকবেন। সামাজিক মাধ্যমে যে ধরনের অডিও, ভিডিও, খুদে বার্তা গুজব সৃষ্টি করে বা গণপিটুনিতে মানুষকে উত্তেজিত করতে পারে তা বন্ধের ব্যাপারে পুলিশের প্রতিটি ইউনিটকে তৎপর রাখার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।