নিজস্ব প্রতিবেদক:
সাধারণ ছুটি তুলে নেওয়ার পর গলির দোকান থেকে শুরু করে বড় শিল্পকারখানা- সবই এখন চালু হয়েছে। আমদানি-রপ্তানি, উৎপাদন, সরবরাহ, বিপণন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও পরিবহন চলাচল আবার স্বাভাবিক হচ্ছে। স্থবির হয়ে পড়া অর্থনীতির চাকাও আবার ঘুরছে। ঘুরে দাঁড়াচ্ছে অর্থনীতি। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার আগের মতো সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেছে, সেটা বলা পুরোপুরি সঠিক হবে না। অর্থনীতি পুরোপুরি পুনরুদ্ধারে আরও সময় লাগবে বলে মনে করছেন অর্থনীতি বিশ্নেষকরা।
করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে প্রায় তিন মাস সাধারণ ছুটি থাকায় অফিস-আদালত, বিপণিবিতান, হোটেল-রেস্তোরাঁ, পর্যটন ও পরিবহন বন্ধ ছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনও বন্ধ রয়েছে। এতে রিকশা ও অটোরিকশা চালক, গণপরিবহন শ্রমিক, ফুটপাতের ব্যবসায়ী, হকার, চায়ের দোকানদারসহ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়েন। অনেকে শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে যান। হোটেল-রেস্তোরাঁ, বেকারি, পর্যটন, এমনকি বিভিন্ন উৎপাদন প্রতিষ্ঠানও কার্যক্রম বন্ধ করে কর্মীদের ছুটিতে পাঠায়। বৈশ্বিক যোগাযোগ ভেঙে পড়ায় আমদানি-রপ্তানিও আশঙ্কাজনকভাবে সীমিত হয়ে পড়ে। শিল্পোৎপাদন কমে যায়। এতে কৃষি, শিল্প ও সেবা তথা সামগ্রিক অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা দেখা দেয়। মানুষের আয় কমে যায়। বাড়তে থাকে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য।
করোনা বিস্তার রোধে শিল্প, সেবা খাতে স্থবিরতা দেখা দিলেও দেশের অর্থনীতির অন্যতম শক্তি কৃষি খাতে তার বিশেষ প্রভাব পড়েনি। করোনাকালেও স্বাভাবিকভাবে চলেছে কৃষি খাতের কর্মকাণ্ড। প্রধান প্রধান ফসল, গবাদি পশু, মাছের উৎপাদন ও বিপণনে সমস্যা হয়নি। ফলে দেশের ১৭ কোটি মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটাতে যেমন কোনো চাপ সৃষ্টি হয়নি, তেমনি গ্রামীণ অর্থনীতিও ভেঙে পড়েনি। তবে ঘূর্ণিঝড় আম্পান, জুলাই-আগস্ট সময়ের অতিবৃষ্টি, পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢল ও নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যা এবং নদীভাঙনের কারণে আউশ, আমন ধান, পাট, শাকসবজি, মসলা এবং গাছপালা ও পশুপাখির ক্ষতি হয়েছে। এরপরও কৃষি মন্ত্রণালয় আশা করছে, কৃষিপণ্যের উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যাবে।
গত ৩ আগস্ট সাধারণ ছুটি তুলে নেওয়ার পর ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। মানুষ স্বাভাবিক সময়ের মতো ঘর থেকে বের হচ্ছে। কাজ করছে। রাজধানী ঢাকাসহ অন্য শহরগুলো আগের চেহারায় ফিরেছে। সড়কে যানজট দেখা যাচ্ছে। সেই আগের মতো দোকান বসছে ফুটপাতে। চায়ের স্টল, কফি শপ, হোটেল-রেস্তোরাঁ চালু হয়েছে। ভিড় বাড়ছে পর্যটন কেন্দ্রে। আমদানি করা নতুন পণ্য নিয়ে জাহাজ ভিড়ছে বন্দরে। আবার অনেক জাহাজ রপ্তানি পণ্য নিয়ে বন্দর ছেড়ে যাচ্ছে বিদেশে। ফলে অর্থনীতিও জেগে উঠছে।
অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তারা বলছেন, ভাইরাসের ভয়ে মানুষ আর ঘরে বসে নেই। জীবন থেমে থাকে না। সারাবিশ্বই ধীরে ধীরে কর্মমুখর হয়ে উঠছে। বাংলাদেশেও কর্মচঞ্চল হয়েছে অফিস-আদালত, শিল্পকারখানা। সর্ব ক্ষেত্রে স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু হয়েছে। ফলে অর্থনীতি গতিশীল হচ্ছে। তবে ভাইরাসের টিকা সবার জন্য নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে বলে তারা মনে করেন।
করোনার কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পর্যটনও জেগে উঠেছে। দেশের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে মানুষ বেড়াতে যাচ্ছেন। সমুদ্রসৈকতে ভিড় জমছে। আবার জমজমাট হচ্ছে বিনোদনকেন্দ্রগুলো। হোটেল-মোটেলগুলোতে ফিরছেন অতিথিরা। বিভিন্ন অনুষ্ঠানেরও আয়োজন হচ্ছে। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন লকডাউনে থেকে মানুষের মনে এক ধরনের অবসাদ দেখা দিয়েছিল। সবকিছু চালু হওয়ার পর মানুষ বেড়াতে বের হচ্ছেন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। এ বিষয়ে কক্সবাজারের কলাতলী নিউ সি বিচের হোটেল সি ক্রাউনের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার বর্ষণ চৌধুরী বলেন, সম্প্রতি পর্যটকরা আসছেন। এপ্রিল-মে মাসে যেমন একেবারেই পর্যটক ছিল না, সে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। এখন কক্সবাজারের হোটেলগুলোতে কমবেশি অতিথি আছেন। এদিকে, পর্যটনের অন্যতম অনুষঙ্গ বিমান চলাচলও শুরু হয়েছে।
পরিবহন চালু হয়েছে পুরোদমে। রাজধানীতে আবার সেই ব্যস্ততা বা যানজট ফিরে এসেছে। এতে জ্বালানি তেলের চাহিদা বেড়েছে। বিপিসি জানিয়েছে, বর্তমানে ১১ হাজার টন জ্বালানি তেল বিক্রি হচ্ছে দৈনিক। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। তবে আয় বাড়েনি বিশেষ। মতিঝিলে ফুটপাতের পাশে চায়ের দোকানি বাবুল মিয়া সমকালকে বলেন, অফিস, ব্যবসা সবই বন্ধ ছিল। মতিঝিলে তো লোকই আসত না। দোকানও বন্ধ ছিল। কোরবানির ঈদের পরে লোকজন আসছে, দোকান নিয়মিত খোলা থাকছে। শহরের শপিং মল, বিপণিবিতানগুলো খুলেছে বেশ আগেই। আগের মতো না হলেও কেনাবেচা শুরু হয়েছে। কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন হচ্ছে।
এদিকে, বাজারে মাস্ক, পিপিই, হ্যান্ডগ্লাভসের মতো স্বাস্থ্য সুরক্ষার সরঞ্জাম, ওষুধ, অক্সিজেন, অক্সিজেন মাপার যন্ত্র, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, বাইসাইকেল, মোটরসাইকেলের বেচাকেনা বেড়েছে বেশ। আবার ইন্টারনেটের পেছনে মানুষের খরচ বেড়েছে, যা ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিকে সামান্য হলেও স্বস্তি দিয়েছে। অন্যদিকে করোনাভাইরাসের কারণে গত ছয় মাস ধরে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কোচিং সেন্টার পুরোপুরি বন্ধ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এ খাতের পরিবহন, শিক্ষা উপকরণের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন চাহিদার অন্যান্য পণ্যের ব্যবসাও তেমন একটা হচ্ছে না।
নর্থ বেঙ্গল সাইকেল ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক আন্দালিব হাসান বলেন, ঈদুল আজহার পরে তাদের কারখানা প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়। পরে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়েছে। সবকিছু আস্তে আস্তে শুরু হচ্ছে। অনেক পশ্চিমা দেশের তুলনায় ভালোভাবে শুরু করতে পেরেছে বাংলাদেশ। তবে এতে খুব খুশি হওয়ার কিছু নেই। এখনও সতর্ক থাকতে হবে।
শিল্পকারখানাগুলো চালু হয়েছে। তৈরি পোশাক, স্টিল, রড, সিমেন্ট, চামড়া, পাট, আসবাবপত্র, সিরামিক, ওষুধ, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, বেকারি পণ্যের কারখানা চলছে জোরেশোরে। দেশের বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী প্রাণ আরএফএল গ্রুপের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল সমকালকে বলেন, মানুষজন ঘর থেকে বের হচ্ছেন। কাজ করছেন। দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবহন চলছে। ফলে বাজারে চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু যে গতিতে চাহিদা বাড়ার কথা ছিল তেমন বাড়েনি। তবে দুই বা তিন মাসের আগের তুলনায় অবশ্যই ভালো। ধীরে ধীরে স্বাভাবিকতার দিকে এগোচ্ছে অর্থনীতি। তবে পূর্ণ স্বাভাবিক হতে কত সময় লাগবে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
ক্যাপিটাল বিস্কুট কোম্পানির মালিক ও ঢাকা চেম্বারের সহসভাপতি মোহাম্মদ বশিরউদ্দীন সমকালকে বলেন, মার্চের পর থেকে খুবই সীমিতভাবে তিনি বেকারির উৎপাদন চালিয়ে আসছিলেন। সম্প্রতি চাহিদা কিছুটা বাড়ায় উৎপাদনও বাড়ানো হয়েছে। তবে পুরোদমে কাজ করা যাচ্ছে না।
অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, সম্প্রতি সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) গতি পেয়েছে। আইএমইডির তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে এডিপি কার্যক্রমে তিন হাজার ২৫০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। এতে রড, সিমেন্ট, ইট, বালুসহ নির্মাণ সামগ্রীর চাহিদা বাড়ছে। জুলাই-আগস্ট সময়ে রপ্তানি আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে বেশি হয়েছে। সর্বশেষ আগস্ট মাসে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ১৭ শতাংশ বেশি রপ্তানি আয় এসেছে বলে জানিয়েছে ইপিবি। অন্যদিকে, বেসরকারি খাতের ঋণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সর্বশেষ জুলাই মাসে বেসরকারি খাতের ঋণে আগের বছরের জুলাইয়ের তুলনায় ৯ দশমিক ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
যদিও অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর মনে করছেন, এই প্রবৃদ্ধির পেছনে ঋণ আদায় ও খেলাপি করার ক্ষেত্রে নীতিমালায় পরিবর্তন আনা এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকার যেসব প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, তার প্রভাব কাজ করেছে।
তবে বাজারে চাহিদার কারণে এনজিওগুলোর ঋণ বিতরণ বেড়েছে। এ সময়ে বিদেশ থেকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই ও আগস্ট মাসে ৪৫৬ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি। রেমিট্যান্সের এই অর্থ অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা সৃষ্টি করছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সমকালকে আরও বলেন, করোনা সংক্রমণকে এখন আর মানুষ সংকট হিসেবে দেখছে না। মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। অনেক কাজকর্ম হচ্ছে। ফলে ধীরে ধীরে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু সেটা এমন নয় যে, সবকিছু আগের মতো হয়ে গেছে বা যাচ্ছে। এপ্রিল, মে, জুন মাসে যে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা কেটে যাচ্ছে। কিন্তু অর্থনীতি করোনার আগের অবস্থায় আসতে আরও সময় লাগবে। কারণ মানুষ ঘর থেকে বের হলেও রোজগার আগের অবস্থায় নেই। তবে অর্থনীতির যে পতন হচ্ছিল অর্থাৎ বেকারত্ব, দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়া- সেটা হয়তো আর বাড়বে না।
রানার গ্রুপের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান খান সমকালকে বলেন, পর্যায়ক্রমে কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। তবে মানুষের মধ্যে ভয় এখনও রয়েছে। এখনও অনেকে ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। বলতে হবে একটু একটু করে শুরু হচ্ছে। পুরোপুরি ঠিক হতে দেড় থেকে দুই বছর লাগতে পারে। তিনি বলেন, কৃষিভিত্তিক ব্যবসা পুরোদমে চলছে। আবার করোনার কারণে নতুন কিছু ব্যবসা দেখা দিয়েছে। ফলে অর্থনীতি শ্নথগতি হলেও ভেঙে পড়বে না। তিনি জানান, এপ্রিল-মে সময়ে রানার গ্রুগের সব অফিস বন্ধ ছিল। মে মাসের একেবারে শেষে স্বল্প পরিসরে কারখানা ও অন্যান্য অফিসে কাজ শুরু হয়। এখন কার্যক্রম বাড়লেও পুরোদমে কাজ হচ্ছে না। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে সবাই একসঙ্গে অফিস করতে পারছেন না।