নিউজ ডেস্ক:
রাজধানীর বুড়িগঙ্গা নদীর তীরঘেঁষা কেরানীগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ‘জিনজিরা’ শিল্পের অভাবনীয় বিস্তার ঘটেছে। জিনজিরার মূল অংশটি তাওয়াপট্টি নামে পরিচিত। তাওয়াপট্টিতে গড়ে ওঠা টিনের ঘরের ছোট ছোট কারখানায় তৈরি হয় বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। এখানকার কারিগররা এতটাই দক্ষ যে, তারা কোনো যন্ত্রাংশের নমুনা দিলে হুবহু তা বানিয়ে দিতে পারেন। সেগুলো টেকসই ও মানসম্মত। আর এসব যন্ত্রপাতি তৈরিতে যেসব মেশিন দরকার হয় তা নিজেরাই বানিয়ে নেন। তাই এটাকে নকল না, অনুকরণ বলে জানিয়েছেন স্থানীয় নাগরিকরা।
এখানকার তৈরি যন্ত্রাংশের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। অনর্গল ইঞ্জিনের ঘট ঘট শব্দ, কারিগরের হাঁকাহাঁকি, শ্রমিকদের কোলাহল ঘুচিয়ে দিয়েছে সেখানকার রাত-দিনের ব্যবধান। ক্ষুদ্র ও হালকা শিল্পে ব্যতিক্রমী সাফল্যের মাধ্যমে কয়েক যুগ ধরেই দৃষ্টান্ত হয়ে আছে জিনজিরা। খ্যাতি আর কুখ্যাতি, সব মিলিয়ে জিনজিরার নাম এখন মানুষের মুখে মুখে।
ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, পলাশী যুদ্ধে সিরাজউদদৌলার পতনের পর তার মা আমেনা বেগম, স্ত্রী লুৎফা বেগম, মেয়ে কুদসিয়া বেগম ওরফে উম্মে জোহরা ও খালা ঘষেটি বেগমকে কড়া পাহারায় বন্দি করে রাখা হয় জিনজিরা প্রাসাদে। তাদের শিকল বা জিঞ্জির পরিয়ে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। মনে করা হয়, এই জিঞ্জির পরানোর ঘটনা চাউর হয়ে গেলে এ অঞ্চলের নাম হয়ে যায় জিনজিরা। তবে যে কারণেই এই নামকরণ হোক না কেন, এমন নামকরণের আগে থেকেই, বিশেষ করে নবাবী আমল থেকে ঢাকার অন্যতম প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে জিনজিরা প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। নদীপথে সারাদেশ থেকে বিভিন্ন পণ্য বুড়িগঙ্গা দিয়ে বিক্রির জন্য এখানকার হাটে তোলা হতো। ব্রিটিশ আমলে জিনজিরার কাঁচাপাট, পাটজাত দ্রব্য, টিনজাত সামগ্রী, মসলা, গজারি লাকড়ি (খুঁটি), বিভিন্ন সাইজের কাঠ, বাঁশ ইত্যাদির জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে। এছাড়া মৃৎশিল্প, লোহার সামগ্রীর জন্যও জিনজিরা ছিল প্রসিদ্ধ।
এরই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান আমলে জিনজিরা ও এর আশপাশের এলাকাগুলোতে বেশকিছু ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প গড়ে ওঠে। এসবের মধ্যে আলকাতরা, নারিকেল তেল, সাবান, ডিটারজেন্ট, শাড়ি লুঙ্গি উলেস্নখযোগ্য। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে রাসায়নিক পদার্থনির্ভর ভোগ্যপণ্য, মেলামাইনসহ
সরেজমিনে জিনজিরার কারখানাগুলো ঘুরে দেখা যায়, ঝুপরি বস্তির অজস্র কারখানায় খুদে ইঞ্জিনিয়ারদের তৈরি করা হাজারো পণ্যসামগ্রীর মধ্যে ঢেউটিন, স্ক্রু, নাটবোল্ট, ক্লাম, তারকাঁটা, জিআই তার, আলতালা, হ্যাসবোল্ট, কব্জা, দা-বঁটি, শাবল, বালতি, চাপাতি, কুড়াল, কোদাল, বিভিন্ন বৈদু্যতিক সরঞ্জাম, ডেকোরেটর সরঞ্জাম, ওয়াশিং টব, পিতলের বার্নার (কেরোসিন চুলা), পিতলের হাঁড়ি, কলসি, তামার হাঁড়ি, ক্রোকারিজ, তাওয়া, টিফিন ক্যারিয়ার, চায়নিজ সাইলেন্সর, আশকল ডুম্বরি, নিক্তিকাঁটা, শাটার, কেঁচি গেট, লোহার জানালা, দরজা, অ্যালুমিনিয়ামের জগ, মগ, লোহার সামগ্রী ছাড়াও মেলামাইন, আলকাতরা, নারিকেল তেল, শাড়ি, লুঙ্গি ইত্যাদি।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বংশ পরম্পরায় জিনজিরার কারিগরদের দক্ষতা কমেনি। তাদের দাবি, বিদেশি পণ্যের আদলে মানসম্পন্ন সামগ্রী তৈরি করতে পারলে দোষের কিছু নয়। এখানকার কারিগরেরা মাত্র ২০/৩০ হাজার টাকা মূল্যের যন্ত্রে পেস্ননশিট থেকে যে মানের ঢেউটিন তৈরি করেন গুণগত মানে তা কোনো অংশে খারাপ নয়। জাপানে এরকম টিন তৈরির জন্য কোটি কোটি টাকার প্রজেক্ট নিতে হয়।
স্থানীয় এক ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম বলেন, জিনজিরার ব্যবসায়ীদের বেশ অভিজ্ঞতা রয়েছে। জাপান, ইতালির মতো অনেক দেশ থেকে যেসব পণ্য বাংলাদেশে আমদানি হয়ে থাকে, সেগুলো জিনজিরার মানুষের তৈরি করা তেমন কঠিন নয়। এর জন্য দরকার সরকারের সহযোগিতা। প্রশাসন ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা না করে নকল ধরার নামে তাদের হয়রানি করায় ছোট ছোট কারখানাগুলো আজ হারিয়ে যাচ্ছে।
কালিগঞ্জের তাসনিম গার্মেন্টসের স্বত্বাধিকারী মো. হাসনাত দেওয়ান বলেন, ত্রম্নটিযুক্ত (রিজেক্ট বা বাতিল পণ্য) ফেব্রিক্স কিনে এনে আমাদের কারিগররা দেশি বিদেশি মডেল দেখে এসব কাপড় তৈরি করেন। সব সময় ভালো দাম পাই না, উপযুক্ত মজুরি দিতে না পারায় সব সময় কারিগরও পাওয়া যায় না।
অপর গার্মেন্ট ব্যবসায়ী আজিজ রাব্বি বলেন, ব্যবসা আমাদের পেশা। এখন এই ব্যবসা ছাড়া অন্য কিছু করা সম্ভব নয়। নগদ বিক্রির চেয়ে বাকি পড়ে বেশি। বিভিন্ন জেলা শহরে লাখ লাখ টাকা পড়ে আছে। একদিকে দেনা, অন্যদিকে ব্যবসা মন্দা।
কেরানীগঞ্জ তাওয়াপট্টি ক্ষুদ্র কুটির শিল্প ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আক্তার জিলানী খোকন বলেন, জিনজিরা বাজারে এখনও শতাধিক লৌহসামগ্রী তৈরির কারখানা রয়েছে। জিনজিরার এসব কারখানা দেশের হার্ডওয়্যার পণ্যের বিশাল চাহিদা পূরণ করছে। এর মাধ্যমে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় রোধ করা সম্ভব হচ্ছে। দেশীয় অর্থনীতিতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে জিনজিরা বাজারে প্রায় ২ শতাধিক বিভিন্ন লৌহ সামগ্রী তৈরির কারখানা রয়েছে। জিনজিরার এসব কলকারখানা দেশের হার্ডওয়্যার পণ্যের বিশাল চাহিদা পূরণ করছে। এর মাধ্যমে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় রোধ করা সম্ভব হচ্ছে। দেশীয় অর্থনীতিতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হাজি সাকুর হোসেন জানান, জিনজিরা নকল সামগ্রী তৈরির বদনাম আমাদের সম্মানহানি করেছে। বর্তমানে এসব নিয়ে কিছুই আর নেই। এখানকার শিল্প উদ্যোক্তাদের বেশিরভাগই এখন দেশের বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক। এখানে বর্তমানে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। লৌহ সামগ্রী ছাড়াও মেলামাইন, আলকাতরা, নারিকেল তেল, শাড়ি, লুঙ্গি ইত্যাদির জন্য জিনজিরা এখন প্রসিদ্ধ। এছাড়া জিনজিরার কালিগঞ্জ দেশীয় গার্মেন্টস, বিশেষ করে জিন্স প্যান্ট তৈরিতে সুনাম অর্জন করেছে। দেশীয় বাজারের জিন্সের প্রায় ৮৫ ভাগ চাহিদা কালিগঞ্জ থেকে পূরণ হচ্ছে।
কেরানীগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহাবুদ্দিন কবীর জানান, জিনজিরাতে নকল পণ্য তৈরির কথা শুনেছি। তবে এখানকার ক্ষুদ্র কুটির শিল্প শতবর্ষের পুরনো শিল্প এবং জিনজিরার ঐতিহ্য বলা যায়। এরা আসলে দীর্ঘদিন ধরে পুরাতন লৌহজাত পণ্য রিসাইকেলিং করে বিভিন্ন ধরনের প্রডাক্ট তৈরির কাজ করে আসছে। এতে দেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
কেরানীগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মেহেদী হাসান বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধার এবং কেরানীগঞ্জের ক্রমবর্ধমান গার্মেন্ট শিল্প নিয়ে রয়েছে মহাপরিকল্পনা।