- এক যুগে মেগা প্রকল্পের পাশাপাশি ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে বিস্ময়কর সাফল্য
- পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলের মতো ‘আইকনিক’ অবকাঠামো চালু হওয়ার দ্বারপ্রান্তে
- আকাশ পথের উন্নয়নে চলছে থার্ড টার্মিনাল নির্মাণ যজ্ঞ
রহিম শেখ ॥ ভঙ্গুর অর্থনৈতিক দশা নিয়ে একাত্তরে যাত্রা শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদে বৈষম্যহীন, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু নবগঠিত বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্নের ওপর দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন, তা স্বাধীনতাবিরোধী ও একাত্তরের পরাজিত শক্তির কারণে বঙ্গবন্ধু সমাপ্ত করে যেতে পারেননি। আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। মূলত আশির দশকে দেশের যোগাযোগ খাতে বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণের ধারা শুরু হয়। ৯০ দশকে গ্রামাঞ্চলে অবকাঠামো উন্নয়নে গতি পায়। গত এক যুগে মেগা প্রকল্পের পাশাপাশি ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটেছে বাংলাদেশে। অর্থনীতিতে গতি আনতে দেশের যোগাযোগ ও পরিবহন খাতের উন্নয়নে সরকারের নেয়া বড় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ শেষ হতে যাচ্ছে আগামী বছর। আলোচিত পদ্মা সেতু আগামী জুনের মধ্যে চালু হবে। এর ফলে দেশের আটটি বিভাগই সরাসরি সড়ক যোগাযোগের আওতায় চলে আসবে। ঢাকাবাসী ইতোমধ্যে দেশের প্রথম মেট্রোরেলের পরীক্ষামূলক চলাচল দেখেছে। আগামী বছরের শেষের দিকে এই ট্রেন যাত্রী নিয়ে চলাচল করবে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন দেশের প্রথম পাতালপথও (টানেল) চালুর কথা আগামী বছরের শেষে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের আলোচিত এসব অবকাঠামো চালু হলে যোগাযোগ ও পরিবহন খাত নতুন যুগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ।
তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের ধারাবাহিক অর্থনৈতিক বঞ্চনা, শোষণ আর নিপীড়ন থেকে মুক্ত হয়ে শূন্য থেকে শুরু করা বাংলাদেশের বয়স এখন ৫০। পাঁচ দশকে পাকিস্তান তো বটেই সেই সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায়ও বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়েছে। সমৃদ্ধ হয়েছে অবকাঠামো আর অর্থনীতির গল্পে। আশির দশকে দেশের যোগাযোগ খাতে বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণের ধারা শুরু হয়েছিল। এরপর পল্লী অবকাঠামো উন্নয়নের বিকাশ ঘটে ৯০ দশকের দিকে। সেই সময়ে গ্রাম-গঞ্জ, পাড়া-মহল্লায় যোগাযোগ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। গত এক যুগে এই খাতে বিনিয়োগ আরও বেড়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলের মতো ‘আইকনিক’ বা নতুন যুগে প্রবেশের স্মারক অবকাঠামোগুলো চালু হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। সরকার ১০টি বড় প্রকল্পকে অগ্রাধিকারের তালিকায় (ফাস্ট ট্র্যাক) রেখেছে। সেভাবেই এগিয়ে চলছে কাজ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সার্বিকভাবে বাংলাদেশের ভৌত অবকাঠামোতে সন্তোষজনক উন্নয়ন হয়েছে। কেবল এখন নয়, তিন-চার দশক থেকেই গ্রামীণ অবকাঠামো বা রাস্তাঘাটের যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে, বিশেষ করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) হওয়ার পর। বেশিরভাগ গ্রামেই রাস্তা আছে। অনেক জায়গায় মহাসড়ক আছে। দ্বিতীয়ত, ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা অঞ্চলে বড় বড় অবকাঠামোসহ বেশ ভাল উন্নতি হয়েছে। বড় বড় রাস্তা এখন মোটামুটি ভাল।’ রেলের ক্ষেত্রে এখনও সন্তোষজনক উন্নতি হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বহু টাকা ব্যয় হচ্ছে কিন্তু আশানুরূপ হয়নি রেলওয়েটা। আমাদের নৌপথ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং সবচেয়ে বেশি নৌপথ ছিল। বহু আগে নৌপথই ছিল সবচেয়ে সস্তা, গুরুত্বপূর্ণ, আনাচে-কানাচে যাওয়া যেত। এখন সমস্যা হলো নদীর নাব্য, বহু খাল ভরাট করে ফেলেছে। এদিকে আমার মনে হয়, নজর একটু কমই। এটার গুরুত্বও অনেক বেশি। ব্যবসা-বাণিজ্য সবদিকেই।’
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে জাতীয় উন্নয়নে বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে আছে পদ্মা সেতু। এটির কাজ শেষ হলে এবং যানবাহন চলাচল শুরু হলে ইস্টার্ন বাংলাদেশ আর ওয়েস্টার্ন বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পৃক্ত হবে। এটার সরাসরি উপকার আছে। প্রতিদিনই ফেরি পারাপার হওয়ার জন্য মানুষের ভোগান্তি হয়। এছাড়া দূরত্ব কমে যাবে। অনেক হিসাবে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু হলে ঢাকার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার কমে যাওয়ার সমান সময় বাঁচবে। এটা তো একটা বিরাট ব্যাপার।’ তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয়ত হলো- ঢাকার মেট্রোরেল চালু হলে ঢাকাবাসীর গণপরিবহনের বিরাট সমস্যার সমাধান হবে। বলা হচ্ছে যে, প্রতি ঘণ্টায় অনেক যাত্রী যাতায়াত করতে পারবেন। বিষয়টি যদিও ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করবে, তবুও যানজট এখন যা আছে তার চেয়ে কমবে, যদি আমরা সময়মতো চালু করতে পারি। একটা (এমআরটি লাইন-৬ বা উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত) যদি চালু হয়, তাহলে কিন্তু এটা উল্লেখযোগ্য। পুরোটা হলে তো কথাই নেই। তাহলে তো ঢাকার রাস্তার পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণের মতো হয়ে যাবে। ঢাকার মতো নগরীতে মোট জমির অন্তত ২৫ শতাংশ সড়ক থাকার কথা, সেখানে আছে পাঁচ শতাংশের মতো। ঢাকার মতো শহরে যদি গণপরিবহনের ব্যবস্থা হয়ে যায় এবং ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখা যায়, তাহলে কিন্তু ঢাকার বোঝা কমবে।’
পদ্মা সেতু ঘিরে তিনটি বিশ্ব রেকর্ড ॥ পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ শেষ করার নির্ধারিত সময় আগামী বছরের জুনে। সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচলের জন্য এখন পিচঢালাই চলছে। এরপর আলোকসজ্জার কাজ করতে হবে। এর বাইরে গ্যাস পাইপলাইন বসানোর কাজ চলমান। গত ৩০ নবেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক কাজের অগ্রগতি ৮৯ শতাংশ। এর মধ্যে মূল সেতুর কাজ শেষ হয়েছে ৯৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। পদ্মা সেতু নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন হয় ২০০৫ সালে। প্রকল্প নেয়া হয় ২০০৭ সালে। ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। কিন্তু নানা জটিলতায় সাত বছর পর মূল সেতুর কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালে। চার বছরের সময়সীমা ধরা ছিল। কিন্তু সময়মতো বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এখন পর্যন্ত ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। সময়মতো কাজ না হওয়ার পেছনে পদ্মা নদীর অননুমেয় রূপ, বন্যায় ভাঙ্গন, করোনা পরিস্থিতিকে দায়ী করা হয়। গত বছরের ডিসেম্বরে সেতুর সর্বশেষ স্টিলের কাঠামো বা স্প্যান বসানোর পর মূলত কারিগরিভাবে জটিল কাজ শেষ হয়। যুক্ত হয় মুন্সীগঞ্জের মাওয়া এবং শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্ত। প্রকল্পের কাজের জটিল প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলতে গিয়ে কর্মকর্তারা বলছেন, এই সেতু ঘিরে তিনটি বিশ্ব রেকর্ড হয়েছে। পদ্মা সেতুর খুঁটির নিচে সর্বোচ্চ ১২২ মিটার গভীরে স্টিলের পাইল বসানো হয়েছে। এসব পাইল তিন মিটার ব্যাসার্ধের। বিশ্বে এখনও পর্যন্ত কোন সেতুর জন্য এত গভীরে পাইলিং প্রয়োজন হয়নি এবং মোটা পাইল বসানো হয়নি। ভূমিকম্প থেকে রক্ষা পেতে এই সেতুতে ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিংয়ের’ সক্ষমতা হচ্ছে ১০ হাজার টন। এখন পর্যন্ত কোন সেতুতে এমন সক্ষমতার বিয়ারিং লাগানো হয়নি। রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে টিকে থাকার মতো করে পদ্মা সেতু নির্মিত হচ্ছে।
সমীক্ষায় এসেছে, এই সেতু দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯ জেলাকে ঢাকাসহ সারাদেশের সঙ্গে যুক্ত করবে। সেতুটি চালু হলে দেশের জিডিপির হার বাড়াবে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়াবে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে প্রতিবছর কী পরিমাণ যানবাহন চলাচল করবে, তা নিয়ে ২০০৯ সালে একটি বিস্তারিত সমীক্ষা করে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এতে দেখা যায়, ২০২২ সালের শুরুতে যদি পদ্মা সেতু উদ্বোধন হয়, তাহলে ওই বছর প্রতিদিন সেতু দিয়ে চলাচল করবে প্রায় ২৪ হাজার যানবাহন। ২০৫০ সালে যা দাঁড়াবে প্রায় ৬৭ হাজার। সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, পদ্মা সেতু চালু হলে পণ্যবাহী যানবাহনের একটা বড় অংশ হবে ভারতের। দেশটির পশ্চিমাংশ থেকে পূর্বাংশে মাল পরিবহন হবে এই পথে। নেপাল ও ভুটানকেও সেতুটি যুক্ত করতে পারবে। এতে আন্তঃবাণিজ্য বাড়বে। পদ্মা সেতু চালুর পর এর পূর্ণ সদ্ব্যবহার এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গত এক দশকে বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত রেললাইন বসাতে ৩৯ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প চলমান আছে। ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত সেতুর দুই প্রান্তে ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ শেষ হয়েছে। সেতু চালু হলে সড়কপথে এই পথ পাড়ি দিতে ১ ঘণ্টা লাগবে বলে সরকার জানিয়েছে। এখন ফেরিতে পদ্মা পার হতেই ২-৩ ঘণ্টা লাগে।
উড়ালপথে মেট্রোরেল দেখেছে ঢাকাবাসী ॥ রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত দেশের প্রথম মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পের কাজের সার্বিক অগ্রগতি ৭২.৯৯ শতাংশ। এই প্রকল্প দুই পর্বে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশ আগামী বছরের ডিসেম্বরে চালু করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এই অংশে ভৌত কাজের অগ্রগতি ৮৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এই পথে চলাচলের জন্য কেনা ছয় সেট ট্রেন (এক সেটে ছয়টি কোচ) জাপান থেকে বাংলাদেশে এসেছে। ইতোমধ্যে এই ট্রেনের পরীক্ষামূলক (পারফর্মেন্স টেস্ট) চলাচল শুরু হয়েছে, যা চলবে ছয় মাস। এরপর তিন মাস ধরে চলবে সমন্বিত পরীক্ষামূলক (ইন্টিগ্রেটেড টেস্ট) চলাচল। পরের পাঁচ মাসে চূড়ান্ত পরীক্ষামূলক চলাচল (ট্রায়াল রান) সম্পন্ন হবে। অর্থাৎ আগামী বছরের ডিসেম্বরে যাত্রী নিয়ে চলাচলের জন্য প্রস্তুত থাকবে ট্রেন। ২০১৮ সালে বুয়েটের করা এক সমীক্ষায় এসেছে, রাজধানীতে যানবাহনের ঘণ্টায় গতিবেগ গড়ে ৫ কিলোমিটার। অর্থাৎ হাঁটা গতি। ১২ বছর আগেও এই গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকার ফলে যাত্রীদের মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে। এই চাপ আবার কাজ করছে অন্যান্য রোগের উৎস হিসেবে। যানজটের কারণে শুধু ঢাকায় দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, যার আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। এই পরিস্থিতিতে ঢাকার কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি) ২০২৪ সালের মধ্যে ঢাকায় তিনটি, ২০৩০ সালের মধ্যে ছয়টি পথে মেট্রোরেল চালুর সুপারিশ করা হয়েছিল। এর মধ্যে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত পথটির নাম এমআরটি লাইন-৬। যার কাজ চলমান। বাকি পথগুলোর নির্মাণকাজ শুরু হয়নি। মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড।