অন্য আকাশের ঠিকানা
সুনির্মল বসু
লোকটা প্রতিদিন বিকেলে সবুজ মাঠে শুয়ে আকাশ দ্যাখে,
দূর আকাশের মেঘের সঙ্গে কথা বলে,
বিলের উপর দিয়ে পদ্ম দীঘির দিকে শীতল বাতাস বয়ে যায়,
দূরের শাপলা-শালুক চেয়ে থাকে,
সুপারি বনে উদাস হাওয়া বয়ে যায়,
নারকেল গাছ মাথা দোলায়,
ধানক্ষেতের উপর আকাশ ঝুঁকে থাকে,
সবুজ মাঠে একাকী শুয়ে থাকলে,
স্মৃতিরা বীনারমতো বেজে যায়,
পাশের জামরুল বন,
দূরের তরমুজ ক্ষেত,
তালবনলোকটাকে দেখে চমকে যায়,
লোকটা তখন খোলা মাঠে হু হু করে কান্নায় ভেঙে পড়ে,
জীবনের এত পরাজয় রাখবার মতো জায়গা নেই,
কত অন্তর্গত বেদনা তখন মনের মধ্যে কথা বলে ওঠে,
মনে হয়, গলা ছেড়ে চিৎকার করে কাঁদতে পারলে,
যেন অনেকটা হালকা হওয়া যেত,
স্মৃতিতে ভাসে শৈশবের দৌড়,
ভালোবাসার ঘর গেরস্থালি,
আত্মজন একে একে চলে গেছে কবে,
মায়াময় দিনগুলো কবে যে কোথায় পথ হারালো,
ভালোবাসার মানুষগুলো একলা ফেলে কোন্ বরফের দেশে চলে গেল,
ওরা কি এখন পাহাড়ের পায়ের কাছে হাঁটে,
জীবনের শুরুতে এমন তো কথা ছিল না,
জীবনের শুরুতে এমন তো কথা ছিল না,
এই পথ ধরে হৃদয়ে দাগা দিয়ে অরুণা চলে গেছে,
সে ছিল কৃষ্ণচূড়া মাধবীলতায় ঘেরা বসন্ত দিন,
জীবনের কোনো আলপথে আর কখনো তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি,
অরুনারা কথা দেয়, কথা রাখে না,
প্রাচীন বন্ধুরা অনেকেই নদীর ওপারে চলে গেছে,
গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেও,
তাঁদের দেখা মিলবে না,
অলকেশ, সুশোভন,
ওরা কোথায় গেল,
সবাই কলম্বাস ম্যাজেলান হয়ে গেলে,
আলোহীন পৃথিবীতে কি করে একা থাকি,
জীবনের অনেকটা পথ এখনো যে বাকী,
এত পরাজয়, এত গোপন কান্না নিয়ে কি বেঁচে থাকা যায়,
খোলা মাঠে শুয়ে লোকটা মেঘেদের সঙ্গে কথা বলে,
আকাশ নদী দূরের জলাশয় অরণ্য পাখি তখন তাঁর বন্ধু হয়ে যায়,
তখন বেশ একটু হালকা লাগে,
আকাশে চাঁদ ওঠে,
তারায় তারায় ভরে যায় নিবিড় আকাশ,
বাঁশবনে উতরোল বাতাস দীর্ঘ প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাসের মতো রিন রিন ব্যথার বেদনায় বেজে ওঠে,
আকাশে ঢাউস ঈগল উড়ে যায়,
লোকটা তখন খোলা মাঠে চিৎকার করে বলে,
সবাই চলে গেছে,
তোমরা আমার সঙ্গে আছো,
আমার সঙ্গে থাকো,
এই সবুজ নিয়ে আমি একদিন চলে যাবো,
এই মাটি, এই আকাশ,
এই অরণ্য পাখির গান সঙ্গে নিয়ে যাবো,
তোমরা আমার সঙ্গে থাকো,
তোমরা ছাড়া আমার কোনো বন্ধু নেই।