আগে একদিনে একশ সেতু উদ্বোধনের পর বুধবার একসঙ্গে একশটি সড়ক-মহাসড়ক উদ্বোধন করে দেশের ইতিহাসে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে আরেকটি মাইলফলক রচনা করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৯ বছর যারা ক্ষমতায় ছিল তারা দেশের কতটুকু উন্নতি করেছে এমন প্রশ্ন রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার পর ’৭২ থেকে ’৭৫ সালে জাতির পিতা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সড়ক ও সেতু মেরামত এবং নির্মাণ করেছেন।
এর বাইরে যারা ২১ বছর ক্ষমতায় ছিল, মানে ২০০৮ পর্যন্ত ২৯ বছর বা ৩০ বছর; তারা দেশের জন্য কী করেছে বা কতটুকু উন্নতি করেছে? আর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থেকে কী করেছে? আমি আশা করি দেশবাসী অন্তত সেটা একটু বিবেচনা করে দেখবেন।
সমালোচকদের উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের শুনতে হয় যে আওয়ামী লীগ সরকার দেশটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে! এর আগে ১০০ সেতু আমরা উদ্বোধন করলাম, আর এখন ১০০টি মহাসড়ক নির্মাণ বা উন্নয়নকাজ সম্পন্ন করলাম। বাংলাদেশের কিছু মানুষ এরপরও বলে আওয়ামী লীগ সরকার এসে দেশ ধ্বংস করে দিয়েছে, কিছুই করে নাই। তবে দেশের মানুষ সেটা বিশ্বাস করবে কেন? সেটাই আমার প্রশ্ন।
বুধবার রাজধানীতে তাঁর কার্যালয় থেকে ভার্চুয়ালি ২০২১ দশমিক ৫৬ কিলোমিটার সম্মিলিত দৈর্ঘ্যরে সড়ক ও মহাসড়কের ৫০ জেলায় ১০০টি জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা মহাসড়ক উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এমন প্রশ্ন রাখেন। একশটি সড়ক এবং মহাসড়ক খুলে দেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী বলেন, এগুলো তাঁর পক্ষ থেকে জাতির জন্য বিজয়ের মাসের উপহার।
অগ্নিসন্ত্রাসী-দুর্নীতিবাজ ও অর্থপাচারকারীদের (বিএনপি-জামায়াত) সম্পর্কে দেশবাসীকে সজাগ ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওই মানিলন্ডারিং, অগ্নিসন্ত্রাসকারী অথবা গ্রেনেড হামলা করে আইভি রহমানসহ মানুষ হত্যাকারী, দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা থেকে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে অন্যের কাছে হাত পাতা, এই ধরনের মানসিকতা সম্পন্ন কেউ যেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসতে না পারেন সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
তিনি বলেন, যারা (বিএনপি-জামায়াত) আমাদের স্বাধীনতায় যারা বিশ্বাস করে নাই বা স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাস করে না, যারা জয় বাংলা স্লোগান দিতে বিশ্বাস করে না, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে না, তারা এদেশের কোনো উন্নতিও চায় না। স্বাধীন বাংলাদেশই তারা চায়নি।
উদ্বোধনকৃত রাস্তাগুলোর মধ্যে শুধু বিদেশী ঋণে ৭০ কিলোমিটার রাস্তার কাজ হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় দুপাশে সার্ভিস লেন দিয়ে সড়কটি চার লেন করা হয়েছে। সড়ক ও মহাসড়কের একটি ২২,৭৭৪ কিলোমিটার সড়ক নেটওয়ার্ক রয়েছে। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এ সময় কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক উপস্থিত ছিলেন। মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী সড়কের সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনা তুলে ধরেন।
আওয়ামী লীগ সরকার ও অন্যান্য সরকারের আমলের তুলনা করে জনগণকে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সকলকে স্মরণ রাখতে হবে যে কখন বাংলাদেশের মানুষ উন্নত জীবন পেল, আর কখন দেশের মানুষ সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ দুর্নীতি এর কবলে পড়ে মানুষের জীবন মান সম্পূর্ণ ধ্বংসের পথে নিয়ে গিয়েছিল, সেটা সকলকে স্মরণ করে সেই তুলনা করেই জনগণকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা কি চান।
১০০টি মহাসড়কের মধ্যে ৯৯টি সরকারি তহবিল থেকে সম্পন্ন হয়েছে, বাকি একটি এবং ৭০ কিলোমিটার গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা মহাসড়ক পর্যন্ত ৬১৬৮ দশমিক ৮৩ কোটি টাকা ব্যয়ে চার লেনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে এডিবি, ওপেক ও আবুধাবির তহবিলের আওতায়। প্রধানমন্ত্রী এর আগে গত ৭ নভেম্বর সারাদেশের ২৫টি জেলায় ১০০টি সেতুর উদ্বোধন করেন।
দেশবাসীর সামনে সরকারের গত ১৪ বছরের ব্যাপক উন্নয়নের সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই সুবিধাগুলো যতটুকুই আপনারা পেয়েছেন, তাতে ’৯৬ থেকে ২০০১ এবং ২০০৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল বলেই পেয়েছেন। আর স্বাধীনতার পর সেই ’৭২ সাল থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলার পথে যত সড়ক ও সেতু নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ করেছেন।
এর বাইরে যারা ক্ষমতায় ছিল ’৭৫ পরবর্তী ২১ বছর এবং ২০০১ পরবর্তী ৬ বছরসহ প্রায় ২৯ বছর বা ৩০ বছর তারা দেশের জন্য কী করছে বা কতটুকু উন্নতি করেছে? আর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকতে কী করেছে দেশবাসী সেটা অন্তত একটু বিবেচনা করে দেখবেন।
তাঁর সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের মাধ্যমে প্রযুক্তিকে মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসা এবং অবাধ তথ্যপ্রবাহের সুযোগ নিয়ে মিডিয়ায় নানা ঢালাও সমালোচনা প্রসঙ্গে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, সত্য-মিথ্যা অনেককিছু বলা যেতে পারে। কিন্তু আমরা বিশ^াস করি সাধারণ মানুষের উন্নয়নে, গণমানুষের উন্নত জীবন-যাপনের ক্ষেত্রে, জনগণের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে।
পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া, শিক্ষার প্রসার ঘটানো, উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করা, কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তোলা, বিজ্ঞান প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের উপযুক্ত দক্ষ মানব শক্তি গড়ে তোলা এবং বিশে^র সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য প্রতিটি বাঙালি যাতে তৈরি হয় সেই লক্ষ্য নিয়েই আওয়ামী লীগ সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, একইসঙ্গে আমরা এদেশের মানুষের শান্তি, উন্নয়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাই। বিভিন্ন সময় নানা বাধা- বিপত্তি সত্ত্বেও তাঁর সরকার লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি আটটি বিভাগে অধিকাংশ রাস্তা নির্মাণ বা উন্নয়ন করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমার মনে হয় বাংলাদেশে আর কোনো রাস্তা বাকি নেই। এই একশ সড়ক ও মহাসড়ক নির্মাণ এবং আগে যেগুলো করা হয়েছিল সেগুলো উন্নতমানের করা হলো। কাজেই এর মাধ্যমে বাংলাদেশে নিরাপদে সড়ক যাতায়াতের একটা বড় সুবিধা হবে। যাতে অর্থনৈতিকভাবে সকল অঞ্চলের মানুষ অত্যন্ত লাভবান হবে।
আওয়ামী লীগ যখনই সরকারে এসেছে যোগাযোগের ক্ষেত্রটাকে সবথেকে গুরুত্ব দিয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, শুধু সড়ক যোগাযোগ নয় সড়কপথ, রেলপথ, নদীপথ এবং বিমান প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই আমরা উন্নয়ন করে যাচ্ছি। জাতীয় সড়ক মহাসড়কের বাইরেও উপজেলা, ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড পর্যন্ত রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হচ্ছে। গ্রামে-গ্রামে পায়ে চলার পথগুলোও আমরা উন্নত করে দিচ্ছি। সমগ্র গ্রাম পর্যায়েও যোগাযোগের একটা নেটওয়ার্ক আমরা গড়ে তুলেছি। মানুষের আর্থসামাজিক উন্নতি যেমন হয়েছে তেমনি চলাচলের সুযোগটাও বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে চাইলে সর্বোচ্চ ৬/৭ ঘণ্টার মধ্যে মানুষ রাজধানীতে আসতে পারছে।
তিনি বলেন, উন্নয়নের যে মূল চাবিকাঠি যার একটা হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, প্রতি ঘরে আমরা বিদ্যুৎ দিয়েছি, সমগ্র বাংলাদেশকে ইন্টারনেট সার্ভিসের আওতায় এনেছি, ব্রডব্যান্ড দিয়েছি, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ আমরা উৎক্ষেপণ করেছি এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ করে দিয়েছি। আর এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর করে গড়ে তুলতে যত রকম কাজের প্রয়োজন তাঁর সরকার করে যাচ্ছে।
সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে কাজ করছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে আমরা স্মার্ট বাংলাদেশী হিসেবে গড়ে তুলব। এই স্মার্ট বাংলাদেশে প্রত্যেকে প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতা অর্জন করবে এবং সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে, সেভাবেই আমরা পরিকল্পনা নিয়েছি এবং সেটা আমরা কিছু বাস্তবায়নও করছি।
সরকারপ্রধান বলেন, জলবায়ুর অভিঘাত থেকে প্রতিনিয়ত আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হই। এর হাত থেকে রক্ষা করে এ দেশের জনগোষ্ঠীকে একটা উন্নত জীবন দিতে চাই। সেজন্য ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ সেটাও প্রণয়ন করে আমরা সেটাও বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছি এবং এটা চলমানই থাকবে। সড়কে চলাচলের নিয়ম-কানুনগুলো শিশুকাল থেকেই শেখানোর তাগিদ দিয়ে অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে এবং চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে প্রশাসনের সকল স্তরের কর্মকর্তাদের নির্দেশনাও দেন প্রধানমন্ত্রী।
দুর্ঘটনা ঘটলে আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোনো দুর্ঘটনা হলে যিনি দুর্ঘটনা কবলিত অনেক সময় জনগণ তাকে সাহায্য না করে গাড়ি চালককে মারধর করা শুরু করে এবং গণপিটুনিতে গাড়ি চালক মারা যায়। এই কাজটা কেউ দয়া করে করবেন না। কেউ ইচ্ছা করে মানুষকে মারে না বা ইচ্ছা করে ধাক্কা দেয় না। যদি অপরাধ করে আপনারা ধরেন, পুলিশে দিয়ে দেন, তার বিচার হবে।
আমরা সড়ক আইনও করে দিয়েছি এটা বিচারের জন্য। তিনি বলেন, অনেক সময় দেখা যায় কেউ রাস্তায় পড়ে গেলে গণপিটুনির ভয়ে গাড়িচালক গাড়ি না থামিয়ে আরেকবার তার উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে চলে গেছে। না গেলে হয়ত সে বেঁচেও যেতে পারত। এই ভীতিটা থেকে চালককে মুক্ত করতে হবে। এটা জনগণের দায়িত্ব।